ছোটবেলায় বড় বোনের হাত ধরে আম কিনতে যেতাম পাড়ার আম গাছওয়ালাদের বাড়িতে। তাদের আম গাছের শাখা-প্রশাখায় ঝুলে থাকা আমের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে ভীষণ মুগ্ধ হতাম। আম কিনে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, বাবা আমাদের আম গাছ নেই কেন? বাবা তখন আমাকে তাঁর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে দিতে বলতেন, আমাদেরও আছে ব্যাটা, তবে সেইটা যাদুর গাছ। সেই গাছে সব ফল পাওয়া যাবে, তুমি যখন যে ফল চাও।
আমি তখন দৌড়ে গিয়ে বাড়ির চতুর্পাশ ঘুরতাম, যাদুর গাছ দেখার জন্য। নাহ্! কোথাও সেই যাদুর গাছের দেখা পেতাম না। আমাদের টিনশেড বাড়িটাই ছিল মাত্র চার-পাঁচ কাঠা জমির ওপর। ছোটবেলায় মামা বাড়ি বেড়াতে ভীষণ ভালো লাগতো। কারণ মামার বাড়িটা ছিল খুব সুন্দর, অনেক বড়। ছাদে উঠার সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আকাশছোঁয়া আনন্দে আত্মহারা হতাম। বাড়ি ফিরে বাবাকে বলতাম, বাবা আমাদের ছাদওয়ালা বাড়ি কবে হবে? বাবা তখনও আমাকে তাঁর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আমাদেরও একদিন অনেক বড় উঁচু বাড়ি হবে ব্যাটা, সেই বাড়ির ছাদে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়বে।
মানুষের গাড়ি দেখে বাবাকে বলতাম, বাবা আমাদের গাড়ি হবে কবে? বাবা সেই আগের মতই বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, ব্যাটা আমি তিনটা যাদুর গাছ পরিচর্যা করছি। এই গাছগুলো একদিন বড় হয়ে আমাদের সব স্বপ্ন পূর্ণ করবে। সেদিনে বাবার কথাগুলো ‘ধুত্তোরি ছাই’ বলে উঁড়িয়ে দিয়েছিলাম, তাঁর মর্মার্থ না বুঝে।
আজ বাবার কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝেছি। বুঝেছি আমার কান ঘেঁসে শ্লথ গতিতে বয়ে যাওয়া তাঁর উষ্ণ শ্বাসের রহস্য। বাবা আমাদের তিন ভাইকে যাদুর গাছের মতই পরিচর্যা করে মানুষ করেছিলেন। তাই হয়তো আজ আমরা বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পেরেছি। আজ পাড়ার মধ্যে আমাদের বাড়ির ছাদের উপরই ভোরের প্রথম সূর্য এসে পড়ে। আজ আমাদের বাড়ি, গাড়ি, বাগানসহ অনেক কিছুই হয়েছে।
উপরওয়ালা মাফ করুন, কথাগুলো গর্ববোধ করে বলছি না। বলছি অন্তর্লোকে জমে থাকা এক থোক লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো কষ্ট থেকে। বাবাকে কোনোদিন বলতে পারিনি, বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
আজ বাবা নেই। বাবা দিবসে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলি, বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।