এক ঝুড়ি স্বপ্ন ছিলো। আধা ঝুড়ি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আধা ঝুড়ি স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যখন আমার জ্ঞান হলো তখন আমরা কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া থানায়। থানার ভিতরে বিশাল দীঘি। স্বচ্ছ টল টলে জল দেখে ইচ্ছে হলো সাঁতার কেটে দীঘিটাকে জয় করি। ভাবনা শেষ না হতেই দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাবুডুবু খেতে খেতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরতেই মা বলল, চলো দীঘিতে যাই। বললাম, আর কখন পানিতে যাব না। বড়ভাই জাকির পরেরদিন দুপুরবেলা আমাকে কোলে করে দীঘিতে নিয়ে যায়। সাঁতার শেখায়। কয়েক দিনের মধ্যে সাঁতার শিখে ফেলি। মাছের মত ডুব সাঁতার চিৎসাঁতার খেলি। দীঘির এপার থেকে ওপার গিয়ে দীঘিটাকে জয় করি। বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। হাটহাজারী বদলী হয়ে গেলেন। বিশাল সমুদ্রের জলরাশি ঠেলে ইঞ্জিনের বড় নৌকায় আমরাও এলাম। আমাদের বাসার সামনে আছারগোলা ফলের গাছ, সাজনা গাছ। জাকির ভাই অনায়াসে গাছে ওঠে আছারগোলা ও সাজনা পাড়ে। ভাইয়ার মত আমিও গাছে উঠার চেষ্টা করি। কিছুদূর উঠেই ধুম করে পড়ে যাই। মনে হলো এই গাছগুলোকে আমি কোনদিনই জয় করতে পারবো না। বড়ভাই জাকির গাছের গায়ে নিজের হাত রাখে। তাতে পা রেখে গাছে উঠতে থাকি। বড়ভাই আমার পেটে হাত দিয়ে সাঁতার শিখিয়ে ছিলো। আজ সেই হাতে পা রেখে গাছে উঠা শিখেছি। একগাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে যাওয়া শিখেছি। সোনালু গাছের ফুল পেরে বুঝেছি গাছগুলোকে আমি জয় করেছি।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়স হয়েছে হাটহাজারি যাওয়ার পর। এখানে প্রতিবছর সার্কাসদল আসে। বাবা আমার মা ও ভাইবোনদেরসহ আমাকে সার্কাস দেখতে নিয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা এখান থেকে ওখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ পড়ে যায় না। দড়ির উপর দিয়ে একটি মেয়ে অনায়াসে হেঁটে যায়। চোখের সামনে স্বপ্ন গাঁথি ওরকম আমিও করবো। মাইকে ঘোষণা দেয় কেউ যেন এমন চেষ্টা না করে। তখনই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। মন ভালো হয়ে যায় সার্কাস দলের মিষ্টিমেয়ের গান শুনে। এমন সুন্দর গান আমিও গাইবো। কণ্ঠশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন বুনি মনে। আমার ইমিডিয়েট বড়বোন হাছিনা। ১৯৮০ সাল। এবছর ওর বয়স পাঁচ বছর। আমার বয়স চার। বাবা হাটহাজারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করালেন দুজনকেই। বড় ভাইয়েরা অনেক বই নিয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু আমার মাত্র দুটি বই। প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখি অনেক বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। বড়ভাই জাকির হোসেনের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। মোটা মোটা অনেক বই। জাকির ভাই কি সুন্দর করে পড়ছে, আমারও ইচ্ছে হয় এমন করে পড়তে। পরের দিন বড়ভাইয়ের মোটা মোটা বই নিয়ে ভোরবেলা স্কুলের দিকে রওয়ানা হলাম। বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে। এই বইগুলো নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য সারারাত দু’চোখের পাতা এক করিনি। স্কুলে যেতে যেতে ভাবি একদিন আমি এমন মোটা মোটা বই পড়বো। স্কুলের স্যার কত সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে মুগ্ধ হয়ে যাই। এমন সুন্দর করে আমিও কথা বলবো সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবে। কিছুদূর গিয়ে বইয়ের ভারে বসে পড়ি রাস্তার পাশে ঘাসের উপর। বইয়ের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালবেলা মা আমাকে বিছানায় না দেখে সব জায়গায় খুঁজে চিৎকার শুরু করলে জাকিরভাই ঘুম থেকে উঠে। ভাইয়া বলল- আমি জানি শিলু কোথায় গেছে। মোটা মোটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল। তাই আমার বড়ভাই বড়রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। রাস্তার পাশে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে কোলে করে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। মা পরে বুঝিয়ে বললেন মোটা মোটা বই পড়তে হলে তোমার ওয়ানের বই প্রথমে পড়তে হবে।
যে কোন গান শুনলেই গাইতে চেষ্টা করতাম। সারাদিন গাইতাম। ছোটদের মিষ্টি ছড়াগুলো খুব ভালো লাগতো। মনে মনে বলতাম ঐরকম ছড়া ও কবিতা যদি আমিও লিখতে পাড়তাম। মা আমাদেরকে অনেক গল্প শুনাতো। স্বপ্ন গাঁথি মনে এমন গল্প, ছড়া, কবিতা আমি একদিন লিখবো। সেরা লেখা হবে। আমি হবো সেরা লেখক।
হাটহাজারীর বাসার ছাদে সীম হয়েছে, বাবা বললেন সীম পাড়তে। বড়ভাই আমি ও হাছিনা ঘরের চালে উঠি। চালে কারেন্টের তার ছিলো। তাতে পা লাগে। বিদ্যুৎ স্পর্শ হয়ে প্রচ- ভয় পাই। চাল থেকে ছিটকে বাবার কোলে পরি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে বলি একদিন আমি বিদ্যুৎকে জয় করবো। আজও বিদ্যুৎকে জয় করতে পারিনি। লেখা শিখবার পর দেখে দেখে ছবি আঁকার অভ্যাস হয়। মনে মনে স্বপ্ন দেখি বড় হয়ে আমি সেরা অংকন শিল্পী হবো। কাটাদেহী বরইগাছে উঠতে পারতাম না। বাবাকে বলতাম বাবা বরই গাছটা নিচু কেন হয় না। এতটা নিচু যেন আমি হাত দিয়ে বরই পাড়তে পারি। বাবা বললেন, আগামী মাস থেকে বরই গাছ নিচে থাকবে তুমি হাত দিয়ে বরই পাড়বে।
পরের মাসে বাবা সাতকানিয়ায় বদলী হয়। রাতে রওয়ানা হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের বাসার উঠানে মস্তবড় বরই গাছ। গাছের ডালগুলো মাটি ছুঁয়ে আছে। হাত বাড়ালেই বরই পাড়া যায়। গাছে অনেক রকমের পাখি। হাছিনা ও আমাকে রুপকানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় ক্লাস থ্রিতে। পরের বছর সাতকানিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে ভর্তি করা হয়। ফইভ পাস করার পর ক্লাস সিক্সে সাতকানিয়া সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় আমাদের। সে বছর আমাদের পাশের বাড়ির মেম্বারের ছেলের সঙ্গে এক এডভোকেটের মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করে। সবাই বলে এডভোকেটের অনেক ক্ষমতা মেম্বার তার ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করে পারবে না। অবশেষে বিয়েটা মেনে নেয় ছেলের বাবা। স্কুলে ইউএনও আসে ভিজিট করতে। আমাদের ক্লাসে অনেককে অনেক প্রশ্ন করে। আমাকে প্রশ্ন করে তুমি বড় হয়ে কি হবে। আমি বললাম বড় হয়ে আমি এডভোকেট হবো। তিনি বললেন এডভোকেট মানে কি? তারা কি করে?
বললাম, জানি না।
স্কুলের ভেতরে আমগাছে অনেক আম ধরেছে। একটা আম কুড়িয়ে পেলাম। কিন্তু কিভাবে খাব। আমার বান্ধবী মিঠু এসে বললো- এই রুমাল দিয়ে আমটাকে ফাটিয়ে লবণ মরিচ দিয়ে খাব। আমার কাছে লবণ মরিচ আছে। স্কুলের পাশেই কর্ণফুলী নদীর শাখা। বালুনদী বলে ডাকে। নদীর পাড়ে অনেক বালু। ওখানে যাওয়া নিষেধ। কারণ ওখানে চোরাবালি আছে। পলিমাটিও আছে। পলিমাটির লোভে যেতাম। পলি দিয়ে আমি মাটির হাঁড়ি, কলসি, কুলা, থালা-বাসন ও নানা রকমের পুতুল বানাতাম। আম, লিচু, তাল, বেল, টমেটো ও অন্যান্য ফল বানাতাম। মাটির পুতুল, বাসন কোসন প্রায় ভেঙ্গে যেত। ভাবতাম এমন মাটি যদি পেতাম যে মাটি দিয়ে এগুলো বানালে ভাঙ্গতো না। সে আশা আজও পূরণ হয়নি। স্কুলে দুটো নাচ শিখানো হয়। ইচ্ছে হলে যদি আরো শিখতে পারতাম। ছয় মাসের পরীক্ষার পর বাবার বদলী হয় লক্ষ্মীপুর। বাবাকে বলতাম এমন নদী কি নেই যেখানে চোরাবালি নেই। শুধু পলিমাটি আছে। নানা রকমের মাছ আছে। ইচ্ছে হলে ধরা যায়। এরকম ¯্রােত নেই। বর্ষার বালুনদীর মত পাড় ভেঙ্গে ভেসে যায় না। হাত বাড়ালে অনেক নারিকেল পাওয়া যায়। একটা নারিকেল ২০টাকা দাম। একটাকায় যদি নারিকেল পাওয়া যেত খুব ভালো হতো। এমন কলাগাছ যদি পাওয়া যেত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতাম খুব মজা হতো। বাবা বললেন, স্বপ্ন পূরণ হবে।
আমরা লক্ষ্মীপুর এলাম। বিশাল বড় বাড়ি, বাড়ির উঠানে কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা, কাঁঠাল ও আমগাছ আছে। কলাগাছে বিশাল ছড়া আমি ও হাছিনা কলাপাতা সরিয়ে এত বড় ছড়া দেখে ভয় পেয়ে যাই। প্রতিটি বাড়িতে নারিকেল গাছ। জোড়া দুইটাকা। তা-ও বিক্রি হয় না। বাড়ির পাশেই পুকুর, তার পাশে রহমতআলী নদী। এখানে চোরাবালি নেই পলিমাটি আছে। নদীর মাছ ইচ্ছে হলেই ধরা যায়। বর্ষায় নদীর পাড় ভেঙ্গে পড়ে না। অনুকূল পরিবেশ আমার সাহিত্যিক মনটাকে পুরোপুরি জাগ্রত করেছে। ক্লাস সেভেনে উঠার পর সাপ্তাহিক এলান পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়। আরেকটি পত্রিকায় বালুনদীর একটি গল্প ছাপা হয়। অষ্টম শ্রেণিতে উঠার পর বার্ষিক দেয়ালিকা পত্রিকার সকল ছবি আঁকি এবং হাতের লেখা সুন্দর হওয়ার কারণে পত্রিকার লেখাগুলোও আমি লিখি। পত্রিকায় একটি গল্প আমার লেখা। শিক্ষক বললেন, তোমাকে দেয়ালিকা পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচন করলাম। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসতে থাকি। পথে আমার জাকির ভাই বললেন, কি ব্যাপার কাঁদছো কেন।
বললাম, ভাইয়া আমি এত কষ্ট করে এত ছবি আঁকলাম আমাকে অংকনে না রেখে সম্পাদক করেছে। সম্পাদক মানে কি?
ভাইয়া তখন লক্ষ্মীপুর সরকারী কলেজে পড়ে। নেতৃস্থানীয় ছাত্র। লক্ষ্মীপুর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক মূল্যায়ন করে। আমাকে নিয়ে ভাইয়া স্কুলে যায়। মানিক স্যারকে বললেন- অংকনে না রেখে সম্পাদক করাতে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
স্যার বুঝাতে লাগলেন পত্রিকার সম্পাদক অনেক বড় বিষয়।
ভাইয়া বললেন, অংকনে নামটা দিয়ে দেন। স্যার বললেন- পত্রিকার প্রায় সব কাজ শামীমা করেছে। ঠিক আছে সম্পাদক ও-ই থাকবে অংকনে রেখার পাশে ওর নাম দিচ্ছি।
অংকনে আমার নামটা দেখে সম্পাদক হওয়ার দুঃখ ভুলে গেছি। দেয়ালিকা পত্রিকা স্কুল পর্যায়ে প্রতিযোগিতা। সম্পাদককে কত কিছু বলতে হয়। হেলেনা আপা আমাদের স্কুল শিক্ষক। আমি বললাম- আমি তো কিছু বলতে পারবো না।
হেলেনা আপা বললেন, আমি লিখে দিচ্ছি দেখে দেখে বলবে। দেয়ালিকা পত্রিকা প্রতিযোগিতায় আমার পত্রিকা ফার্স্ট হলো। স্কুল পর্যায়ে, থানা পর্যায়ে, জেলা পর্যায়েও প্রথমস্থান অধিকার করে লক্ষ্মীপুর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য অর্জন করেছি সম্মাননা ও পুরস্কার। স্কুল পর্যায়ে অংকন প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রতিযোগিতায় নাম দেয়ার সময় হাছিনা এসে বলল, তুই ‘ঘ’ শাখায় নাম দে। কারণ ‘ঘ’ শাখায় আর কোন প্রতিযোগী নেই। আমি ‘ঘ’ শাখায় নাম দেই। একজন ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের বিচারক। প্রতিযোগিতার পর ঘোষণা দিলেন আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম হয়েছি। তখন আমার বার বছর বয়স। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে বুঝিনি।
হাছিনা বলল, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় নাম দে। লটারিতে টান দিয়ে যা উঠবে তা নিয়ে বলতে হবে। আমার ভাগ্যে পেন্সিল পড়ে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকি কিছু বলতে পারছি না। পাশ থেকে হাছিনা বলল, বল আমরা ছোটবেলায় পেন্সিল দিয়ে লিখি। একলাইন তিনবার বললাম। আমার ইমিডিয়েড বড়বোন হাছিনা ও আমি একই ক্লাসে পড়তাম। সে কোন প্রতিযোগিতায় থাকতো না। তবে আমার পাশে থাকতো সব সময়। হাছিনা বলল, পেন্সিলে আমাদের হাতেখড়ি হয়। এই লাইনও তিন-চারবার বললাম। হাছিনা বলল, পেন্সিল ছাড়া আমাদের চলে না। ম্যাজিস্ট্র্রেট জাহাঙ্গীর সাহেব বললেন, থাক আর বলতে হবে না। তুমি ফার্স্ট হয়েছো। হেলেন আপা বললেন, না ওকে আরও বলতে হবে নয়তো ভয় ভাঙবে না। এই কথা শুনে আমি কেঁদে ফেলি। সবাইকে হাতে তালি দিতে বলে ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর সাহেব। আমি স্টেজ থেকে নেমে আসি। বুকটা ধকধক করছিল। মনে হলো কেউ ড্রাম পিটাচ্ছে। অংকনে প্রথম পুরস্কার নিয়ে ফেরার পথে হাসপাতাল রোডে জাকির ভাইয়ের সাথে দেখা। আমার জীবনে ব্যক্তিগত প্রথম পুরস্কার এই বইটি। নাম পুঁই ডালিমের কাব্য। বই পুরস্কার দেওয়াতে খুব ভালো লাগছিল। ভাইয়া বলল, শিলু অংকনে প্রথম হয়েছে খুশি নয় কেন?
হাছিনা বলল, উপস্থিত বক্তব্য পারেনি তাই। বললাম সে কারণে নয়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম স্থান বলল কেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে কি? আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কেউ ছিল না নাকি আমার সাথে কেউ পারেনি কোনটা? ভাইয়া বলল, তোমার সাথে কেউ পারেনি তাই তুমি প্রথম বললাম, তাহলে ঠিক আছে। এরপর বেড়ে যায় আমার ছবি আঁকার উদ্যামতা। ছবি আঁকার পর আমার জাকির ভাই সে ছবিগুলো আমাদের ঘরের দেয়ালে গাম দিয়ে লাগিয়ে দিত। চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা স্কুল পর্যায়ে, থানা পর্যায় এবং জেলা পর্যায়েও প্রথমস্থান অধিকার করি। পরের প্রতিযোগিতায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নয় অনেক প্রতিযোগী ছিলো। হ্যান্ডবল খেলার প্লেয়ার ছিলাম অষ্টম শ্রেণি থেকে। স্কুল পর্যায়, থানা পর্যায়, জেলা পর্যায়ে হ্যান্ডবল খেলে লক্ষ্মীপুর বালিকা সরকারী বিদ্যালয়ের জন্য অর্জন করেছি সম্মানানা ও পুরস্কার।
বাবা আমার লেখা কবিতা ও গল্প পত্রিকায় ছাপা হলে সংগ্রহ করে যত্ন করে রাখতেন। শতবার পড়তেন। রচনা প্রতিযোগিতায় স্কুল, থানা, জেলা পর্যায়ে বরাবরই আমি প্রথম হতাম। স্কুলে বিজয়দিবস উপলক্ষে অংকন প্রতিযোগিতায় আমি দ্বিতীয় হই। কাঁদতে কাঁদতে হেডস্যারকে বললাম- প্রথম যে হলো সে তো শহীত মিনার আঁকতে-ই পারেনি সে কি করে প্রথম হলো।
হেড স্যার মোতাহের সাহেব বললেন- ওর বাবা ডিসি। এই অনুষ্ঠানের সব খরচ তিনি দিয়েছেন তাই ওকে ফার্স্ট করেছি। ডিসি কি বুঝতাম না। তাকিয়ে দেখি তিনি একজন মানুষ। সাহস করে কাছে যাই। স্যারকে যা বললাম, তাই বলেছি। তিনি প্রতিযোগিতার ফলাফল হাতে নিয়ে দুজনকে যুগল প্রথম ঘোষণা করেন।
ক্লাস নাইন থেকে দশম শ্রেণিতে উঠতেই হাছিনার বিয়ে হয়ে যায়। এবার আমার পালা। আমি বাবা-মাকে বলি, আমাকে বিয়ে দিলে আমি অত্মহত্যা করবো। আমি অনেক পড়াশুনা করবো। আমি বড় হয়ে এডভোকেট হবো, অনেক বড় সাহিত্যক হবো। সবাই আমাকে চিনবে। হাছিনার স্বামী ও আমার চাচা ইদ্রিস মিয়া আমার লেখাপড়ার ঘোরতর বিরোধী। তারা বলতো, মেয়ে মানুষ পড়াশুনা করে জজ ব্যারিস্টার হবে নাকি।
মা বলতো- হতেও তো পারে। বাড়ি ও বাহির থেকে কোন লোক আসলে পুতুলের ঘরে বসে পড়তে থাকি। দেখলেই বলতো এত বড় মেয়ে বিয়ে দিচ্ছো না কেন? অনেক গুনাহ হবে। হাছিনার স্বামী শফিকুল ইসলাম জাবিদ ও আমার চাচা আমাদের বাসায় আসলেই ধর্মের নামে ঝড় তুফান তুলে মানসিক অত্যাচার করতো। চাচা মরে যাওয়ার সময় ও আমার এডভোকেট হওয়াটা সুনজরে দেখেনি। তার ছেলেরাও। হাছিনার স্বামী শফিকুল ইসলাম আবিদের এখন আল্লাহ্ তায়ালার পরের ভরসা আমি। এসএসসি পাস করার পর গান গাওয়ার স্বপ্নটা ঘুমের ঘোরে বরাবর দেখতে থাকি। একদিন লক্ষ্মীপুর বাজারে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কম্পানির দোতলায় বসে গান গাইছি আপন মনে। যদুই বাবু কুমার পাল কোন কাজে এসেছিলেন বললেন- গানের গলা খুব সুন্দর। গান শিখবে। বললাম- হ্যাঁ।
লক্ষ্মীপুর গালর্স স্কুলে দুইবার একক চিত্র প্রদশর্নী হয়েছে আমার। যাদুই বাবু বললেন- তোমার গান শিখতে টাকা লাগবে না। তুমি আমার জেলা সংগীত একাডেমিতে ছবি আঁকা শিখাবে শিশুদের বিনিময়ে আমি তোমাকে বিনা টাকায় গান শিখাব। অংকনের ক্লাস থেকে যা আয় হবে তার অর্ধেক তোমাকে দেবো। আমাকে ঠিকানা লিখে দিলেন। আমি পরের শুক্রবার ভুল করে চলে গেলাম উপজেলা সংগীত একাডেমিতে। সেখানকার শিক্ষক আবুল বাসার। সব শুনে বলল- তুমি ঠিক স্থানে এসেছো। এখানে তুমি অংকনের ক্লাস নেবে। বিনিময়ে আমি তোমাকে গান শিখাবো। আবুল বাসার স্যারের সাথে আমার ক্লাস সিক্স থেকে পরিচয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে দেখা হতো। তিনি আমাদের বালিকা বিদ্যালয়ের একটি রুমে থাকতেন। আমার লেখা প্রথম উপন্যাস ৭ম শ্রেণিতে পড়াকালীন লিখেছিলাম। বাসার স্যার প্রথম পড়ে বলেছিলো, এতটুকু মেয়ে উপন্যাস লিখেছো ভাবা যায় না। খুব ভালো হয়েছে। একমাস পর যদুই বাবু আমাদের বাসায় আসে। আমার কাছে সব শুনে সাথে করে জেলা সংগীত একাডেমিতে নিয়ে যায়। অংকনের শিক্ষক আমি সংগীতের ছাত্রী।
বাসার স্যারের গানের স্কুলে না যাওয়াতে কয়েক মাস পর বাসার স্যার বাসায় এলেন। সব শুনে বললেন, সপ্তাহে একদিন আমার বাসায় আমার মেয়েদের সাথে গান শিখতে এসো। বাসার স্যারের সেই ছোট্ট মেয়ে নুপুর ও রূপো এখন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিকা। প্রত্যেকে অনার্স এম এ পাস। খুব ভালো গান করে। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে পড়াকালীন আমার একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। প্রদর্শনী সাজাতে জেড এম ফারুকী স্যার আমাকে সর্বাত্মক সাহায্য করেছিলেন। স্কুলের প্রদর্শনী সাজাতে মানিক স্যার সাহায্য করেছিলেন। কলেজে উঠে আমি বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। কলেজে চিত্র প্রদর্শনী সাজানোর সময় ফারুকী স্যার বললেন- এত কষ্ট করছো তোমার জন্য কোন বাজেট নেই। তোমাকে কোন প্রাইজ দেয়া হবে না। আমার মন খুব খারাপ। তিনদিন পর পুরস্কার বিতরণী। প্রথম প্রাইজ দেয়ার জন্য ফারুকী স্যার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ভালো পুরস্কার আনলেন। মাইকে নাম ঘোষণা করা হলো। আমি চমকে উঠি। স্যারেরাসহ সকল ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে হাততালি দিলো। এটি ছিল আমার শ্রেষ্ঠ স্মৃতির একটি। লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে ঢাকায় আসি বাংলায় এম এ এবং একই সময় এল এল বি ভর্তি হই। ২০০১ সালে আমার সনদ হয়। ১৯৯৬ সালে বিয়ে হয় তারপর সন্তান অর্নবকে কোলে নিয়ে বাকী পথ পাড়ি দেই। এডভোকেট হিসাবে সনদ প্রাপ্ত হই ২০১১ সালে।
বাবা বারবার বলতেন, তোমার এত লেখা ছাপাবে না। সাহিত্য জগতের তারকা হওয়ার জন্য স্রষ্টা আমার জন্য একটি ভয়ংকর কালো অধ্যায় রচনা করেছিলেন। সে অধ্যায় পার হয়েছি বাবা মা ও স্বামী ও মোশারফ ভাইয়ের পবিত্র হাত ধরে। ২০০৮ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২/৩ টা করে বই বের হতো। তারপর ৭/৮টা । ২০১২ সাল থেকে ১০/১৪ টি মোট ৮৫টি গ্রন্থ বের হয়েছে। কবিতা, সায়েন্সফিকশন, গবেষণামূলক, আইনভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক, প্রেম, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ছোট গল্প ছোটদের গ্রন্থ-ছড়া, কবিতা গল্প প্রকাশিত হয়। ছোটদের গ্রন্থে আমার আঁকা অংকন অলংকৃত করছে। গানের মেধা নিজের সন্তান অর্নব খুব ভালোভাবে ধারন করেছে। অর্নি অর্পাও।
লক্ষ্মীপুর অংকনের শিক্ষক থাকাকালীন আমার একছাত্র ছিলো নাম অর্নব। নামটা আমার খুব পছন্দ ছিলো। তাই স্রষ্টার কাছে বলেছিলাম, আমার প্রথম সন্তান পুত্র হবে তার নাম হবে অর্নব। আমার অর্নব গানের জগতের তারকা হবে এবং মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনামাটি দিয়ে ভাষ্কর্য তৈরি করার ইচ্ছা ও স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে। নিজের যোগ্যতাবলে গান গাই। গান শিখাই। নিজের সন্তান সেরা স্বপ্নের আরেক প্রাপ্তি। গীতিকার ও সুরকার হয়ে ছেলের কণ্ঠে ধারণ করিয়ে অধ:গমন তারকা হয়ে রয়েছি এটাও কম নয়।