চোর : জান্নাতুল ফেরদাউছ

0
1200

 

ছোট্টবেলার কথা। প্রতিদিন রাতে ঘুমুতে গেলেই ভাবতাম আজ রাতে চোর এলে সবাইকে আমি জাগিয়ে দেব চোর চোর বলে। গরমের দিন। মাটির উপর শীতলপাটি বিছিয়ে নানি আমার মামাতো ভাই বোনদের সহ একসাথে ঘুমাতো। মাটিতে শোয়াতে ঘরের নিচে পায়ার ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্যগুলো চোখে পড়ত। প্রতিদিন শুয়ে শুয়ে ভাবতাম এই বুঝি চোর এসেছে। নানি ও নানি। কিরে কি হইছে। চোর আসছে মনে হয়। নানি ফুচি মেরে নিচের দিকে দেখে বলতো তোর মাথা, এগুলো সুপারি গাছের ঠ্যাং! ভালো করে তাকিয়ে দেখতাম তাই তো, ঘরের পাশেই সারি সারি সুপারি গাছ। মনে মনে ভাবতাম একদিন সত্যিই চোর আসবে আর আমিই সাহস করে সেই চোরকে ধরিয়ে দিব। আশেপাশের অন্য ঘরে চোর আসে কিন্তু এদিকে আসেনা, মনে হয় আমাকে ভয় পায়।

মামার বাড়ির পাশে একটা ঈদগাহ ময়দান তা পেরুলেই খালার বাড়ি। সেই খালার বড়িতে টিভি এনেছে। ব্যাটারী দিয়ে চালায়। আমরা ছোটরা সবাই বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম টিভি দেখতে। এমনই একদিন টিভি দেখে ঈদগাহের উপর দিয়ে হেঁটে আসছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল ঈদগাহে নাকি ভূত থাকে। আকাশটাও মেঘলা, সাথেও কেউ ছিলনা। চোখ মুখ বন্ধ করে খিঁচে একটা দৌঁড় দিলাম-মনে মনে একটু লজ্জা পেলাম আমি এত ভীতু। হুহ আমি ভুতকে ভয় পাই কিন্তু চোরকে ভয় পাইনা। আসুক না চোর ব্যাটা, পরক্ষণেই নিজে নিজে বলে উঠলাম।

চুপি চুপি ঘরে ঢুকে আমার খাঁটে আমি শুয়ে পড়লাম। গভীর রাত, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ যেন কার হাত অনুভব করলাম আমার ডান হাতের উপর, চোখ বন্ধ রেখেই বাম হাত সে হাতের উপর রাখলাম। আস্তে করে হাতটি আমার হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেলো। চিন্তা করছিলাম এ কার হাত? আমার সমবয়সী খালাতো বোন একজন মাঝে মাঝে এসে আমার সাথে এসে ঘুমায় ভাবলাম ও নাতো। ওর হাত কি এত্তো বড়! এ হাত তো আমার হাতের চেয়েও ডবলের ডবল। ভাবনায় ছেদ পড়লো শরীরে টপটপ বৃষ্টির ফোটা পড়ায়। চোখ মেললাম। দেখি দখিণের ঈদগাহ আর উন্মুক্ত মাঠ চোখের সামনে, ঘরের বেড়া নেই সম্পূর্ণ খুলে ফেলেছে! কোনরকম তোতলাতে বললাম মা-মা-চো-ও চো। সেই সাথে অস্ফুট স্বরে কান্না।

ভিতরের রুম থেকে মামা হারিকেন নিয়ে এল কিরে কি হয়েছে? মামাকে দেখে দমে একটু পানি এল। কোনরকম বললাম চোর-ও-র। অমনি তো মামা বেড়ার দিকে তাকিয়ে থ! আরে কখন আসলো শালা। আমি তো ঘুমাই নাই, রেডিও শুনছিলাম তুই আমাকে জোরে ডাকবিনা। মামার চিৎকারে মামী নানি এন্ডা বাচ্চা সব ঘুম থেকে  উঠে গেল। আমি মেঝেতে নানির কাছে গিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না জুড়ে দিলাম। ঐদিকে মামা “কৈ  রে মান্নান, নুরুল আমিন, তাফাজ্জল তাড়াতাড়ি আয় তাড়াতাড়ি আয়। চোর চোর বলে চিৎকার করে সব মামাদের একসাথে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল চোর ধরতে। পেছন থেকে বড় মামী বলছে “বৃষ্টি পড়ছে তোমরা যেয়োনা, চোর তো মনে হয় এতক্ষণে পগাড় পাড়ি দিয়েছে।

আরে না যাইবো কই, এই দীঘির পাড়ে চুরি, এত্তবড় সাহস!

এদিকে সব মামি নানিরা পুচকে পাচকেসহ আমাকে ঘিরে ধরেছে। ততক্ষণে আমি চোখের পানি নাকের পানি মুছে একটু ধাতস্থ হয়েছি। এক নানি ভেংচি কেটে বললো এই নি আমাগো নাতির বীরত্ব, রাত জেগে  চোর পাহারা দেয় আর চোর দেখতে না দেখতেই কান্না! হু-হু-উ।

থাক থাক ছোট মানুষ আর বেশী কিছু বলেন না। ওর মামারা ঠিকই চোর ধরে নিয়ে আসবে। যেভাবে লুঙ্গি গোছ মেরে বেরিয়ে গেছে! বলল আরেক মামী।

বড় মামী পান চিবুতে চিবুতে বলল, হু-হ দেখুম নে কোন বোয়াল মাছ ধরে আনে।

রাত বাড়ছে সেই সাথে টেনশনও, মামারা বেরিয়েছে অনেক্ষণ হলো এখনো আসছেনা। সবাই কান পেতে আছে এই বুঝি মামার হুংকার শুনা যাবে। কিছুক্ষণ পর বাইরে মামাদের কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে এল। সবাই দৌড়ে হারিকেন, বাতি নিয়ে বেরিয়ে এলা চোর এসেছে চোর এসেছে বলে। আরে আর অল্প একটুর জন্য চোরটা হাতছাড়া হয়ে গেলো।

চার মামাকেই চোরের মত দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে আর সারাগায়ে কাঁদা মেখে তাদের একেকজনকে মনে হচ্ছে ছিচকে চোর। আমার খুব হাসি পাচ্ছিল, মনে মনে খুব হাসছিও আমি। বড় মামী হ আমি জানতাম তোমরা কেমন চোরা ধরার লোক। আরে আগে তো ঘরে বসতে দিবা দু-এক খিলি পান টান দিবা তারপরেই না বাকি কথা শুনবা।

সবাই হুড়মুড় করে ঘরে এল-মামারা কাদাটাদা ধুয়ে পরিস্কার হয়ে গোল করে বসলো।

chor 2

বড় মামা চোর ধরার কাহিনী বর্ণনা করা শুরু করল, আমরা চোরের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে ঐ যে ধেলার পাটারী বাড়ির চৌরাস্তার মোড়ে যেয়ে চোরকে হারিয়ে ফেললাম হঠাৎ মনে হল চোর পাটারী বাড়ির একটা ঘরের দরজা খোলা ছিল সে  ঘরে ঢুকে পড়েছে। আমরা বুদ্ধি করে চারজন চৌরাস্তার চার মাথায় লুকালাম, মান্নান কে বললাম যেই-না চোর আসবে অমনি চারদিক থেকে সবাই মিলে ধরে ফেলবো। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম চোর বেটা চুপি চুপি পা টিপে সামনে দিয়ে যাচ্ছে অমনি ঝাপিয়ে পড়লাম ধরছিরে চোর ধরধর আশেপাশের সবাই এসে জড়িয়ে ধরলো। চোরকে মান্নান লাইট কই লাইট মার দেখি চোর হালার চেহারা দেহি। ওদিকে চোর তো বলছে আরে ভাই, আমি চোরনারে ভাই আমি তো আপনের ভাই। হ ধরা পড়লে সব চোর ভাই হয়ে যাই।

বড় মামার কথা শেষ না হতেই মান্নান মামা বলল আমার লুঙ্গির গিট্টু এতজোরে লাগানো ছিল যে আমি লাইট যত টানি লাইট আর বের হয়না শেষমেষ লাইট ও বের করলাম ওদিকে লুঙ্গিও ছুটে পড়িমড়ি অবস্থা। অবশেষে লাইট মেরে দেখি চোর বলে কাকে ধরলাম আরে এতো আমাদের তোফাজ্জল। ততক্ষনে সে বলল আমি তো বলতাছি আমি আপনের ভাই আপনারা তো আমার কথা শুনেন না।

কেন তুই কাউকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া গর্ত থেকে বের হতে গেলি। বললো আমার পায়ের উপর দিয়ে সাপের মত কি একটা যেন সিরসির করে বের হয়ে গেল, ভাবলাম ও পাশের রাস্তায় যেয়ে দাঁড়াই আর অমনি তো তোমরা চোর বলে দুরুম-দারুম শুরু করে দিলে! অবশেষে কি আর করা চারজন-ই চোর ব্যাটার মন্ডুপাত করতে করতে ফিরে এলাম।

বড় মামী ফোঁড়ন কেটে বললো যেমন মামা তেমন ভাগ্নে- চোরের কপাল ভালো আজকে।  আজও মামাদের চোর ধরার কাহিনী মনে হলে নিজের অজান্তেই হাসি পায়- মনে হয় চোরের জন্য তাদের চার ভাইয়ের হাডুডু খেলার কথা!

একটি রিপ্লাই দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.