অনেক অনেক দিন আগের কথা। সে সময় এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করতো। তাদেরকে বণিক, সওদাগর, ব্যবসায়ী বলা হত। এমনি এক বণিকের কথাই বলছি। বণিক যে রাজ্যে বাস করতো সেই রাজ্যে এখন অভাব অনটন। তাই সিদ্ধান্ত নিলো কালকেই অন্য রাজ্যে চলে যাবে ব্যবসা করতে। বাড়িতে কিছু যব ছিলো। বণিকের বৌ সেগুলো ভেঁজে যাঁতায় পিষে একটা পুটলিতে বেঁধে বণিকের যাবার সময় হাতে ধরিয়ে দিল। কিন্তু যাঁতায় পেষার সময় বণিকের বৌ এর চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিষাক্ত অতি চিকন একটা সাপ যাঁতার ভিতরে ঢুকে পড়ল। ব্যাচ, সঙ্গে সঙ্গে যাঁতায় পিষে যবের সাথে মিশে গুঁড়ো হয়ে বেরিয়ে এল।
বণিক তার বৌ এর দেওয়া ছাতুর পুটলিটা কাঁধে ঝুলিয়ে চললো এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। কোন রাজ্যে যাবে তার কোনো নির্দিষ্ট ছিলো না। সারাদিন সারারাত কোনো বিশ্রাম ছাড়াই হেঁটে চলেছে। বনে জঙ্গলে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুকের যে উৎপাত তাতে কোনো জায়গায় বিশ্রাম নেওয়া মানে নিশ্চিত ওদের পেটে যাওয়া। জঙ্গল পার হতেই রাত কাবার। সকালবেলা এসে পড়ল অচেনা অজানা এক রাজ্যে। ক্লান্ত শরীরে বসে পড়ল একটা বিরাট বটগাছের ছায়ায়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা নদী। ক্ষিধেয় পেটটা চো চো করছে। পুটলিটা খুলে রেখে একটা পাত্র হাতে নিয়ে নদীতে হাত মুখ ধুতে নামল। হাত মুখ ধুয়ে পাত্রে পানি নিয়ে উপরে উঠেই দেখে একটা হাতি তালগাছের মত থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বণিক পড়িমরি করে কোনোমতে উপরে উঠে দেখে হাতিটা তার সমস্ত খাবার খেয়ে বিনাশ করে ফেলেছে।
হাতিটা শুঁড় নিচের দিকে ঝুলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বণিকের পেটে কেমন জানি চো করে উঠল। ক্ষিদে পেটে হঠাৎ রাগ উঠে গেল মাথায়। রাগের মাথায় হাতিটির কুলোর মত কান বরাবর কষে দিল এক চড়। ব্যাচ হয়ে গেল। আরে বুঝতে পারছো না চড় খেয়ে হাতি চিৎপটাং। এদিকে হাতিটি ছিল ঐ দেশের রাজার খুব প্রিয়হাতি। রাজার নাকাল মনে রাখাল দূর থেকে বণিকের এই কা- দেখে দৌড় দিলো রাজ দরবারে। কি করবে? সে কি পারবে ঐ বণিকের সাথে? রাজার হুকুমে সৈন্য সামন্ত এসে ধরে বেঁধে নিয়ে গেল রাজ দরবারে। রাজা সিংহাসনে বসে হুংকার দিয়ে বললো, ‘কে তুমি? কেনইবা আমার হাতিটিকে মারলে?’
বণিক একটু সাহস নিয়ে বললো, ‘জাঁহাপনা, আমি আপনার রাজ্যে ব্যবসার জন্য এসেছি। হাতিটা আমার খাবার খেয়ে ফেলেছিল। আমি ক্ষুধার্ত। রাগের মাথায় একটা চড় মেরেছি মাত্র। আর ওমনি মরে গেল। আমি ইচ্ছে করে মারতে চাই নি জাঁহাপনা। গুছতাকি মাফ করবেন।’ কথায আছে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। তাই রাজা হুকুম করার আগেই সেনাপতি রাজার নিকটে গিয়ে চুপি চুপি বললেন, ‘জাঁহাপনা, যে লোকটা একচড়ে একটা হাতি মারতে পারে, সে নিশ্চয় খুব শক্তিশালী। রাজ্যে এমন পালোয়ানের খুব প্রয়োজন। ওর গর্দান না নিয়ে যদি কারাগারে বন্দি রাখা যায় তাহলে খুব ভালো হতো।’
রাজা গোঁফ নাচিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘ঠিকই বলেছো সেনাপতি। কথা একেবারে মন্দ না। এই কে আছিস, বণিককে নিয়ে যা কারাগারে।’
প্রিয়হাতির শোকে কাঁদতে যেয়েও কাঁদতে পারল না। পাছে ভয় আছে। সভাসদ রাজার কান্না দেখলে রাজার লজ্জা পাবে। কিছুদিনের মধ্যে কথাটা একরাজ্য থেকে আরেক রাজ্যের রাজা প্রজাদের কানে কানে পৌঁছে গেল। হরিপুরে বণিক পালোয়ান একচড়ে একটা হাতি মেরে ফেলেছে। শুধুকি তাই? একদিন সেনাপতি কারাগারে বণিককে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হে সাহসী শক্তিশালী পালোয়ান, একচড়ে হাতি মেরে ফেলা ছাড়া আর কি কৃতিত্ব আছে তোমার?’ বণিক মনে মনে বলে, ‘আরে বোকা সেনাপতি হাতি যে কিভাবে মরেছে তা আমিও জানি না।’
তবে বণিক সেনাপতির প্রশ্ন শুনে বললো, ‘আমি একচড়ে পাঁচ পাঁচটামানুষ মেরে ফেলেছি।’ সেনাপতি একথা শুনে আঁতকে উঠে সে যে কী দৌড়। বণিক দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললো, ‘এই যা কী বলতে কী বলে ফেলেছি।’ চেঁচিয়ে বললো, সেনাপতি আমি ভুল বলেছি। এক চড়ে পাঁচটা মানুষ মারিনি, পাঁচটা মাছি মেরেছিলাম। ঘি দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় হাতে পাঁচটা মাছি বসেছিল। সেইগুলোই মেরেছি।’
কে শোনে কার কথা। সেনাপতি একেবারে ভীতু প্রকৃতির লোক। খুব ভয় পেয়েছে। দিন যায়, হপ্তা যায়, মাস যায়, বছর যায় বণিকের শাস্তি শেষ হয় না। বণিক কারাগারে ভালো ভালো খাবার পাই।
খাবার খায় আর মোটা হতে থাকে। একদিন হরিপুর রাজ্যে হৈচৈ বেধে গেল। প্রজারা এসেছে রাজার দরবারে। রাজা সিংহাসনে বসে হুংকার দিয়ে বললেন, ‘সেনাপতি, প্রজাদের কি অভিযোগ?’ সেনাপতি ভয়ে ভয়ে বললো, ‘জাঁহাপনা, রাজ্যের মানুষ খুব আতংকে আছে। বনের একটা বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করছে। যে কোনো সময় লোকালয়ে ঢুকে পশু পাখি ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুদের পর্যন্ত ধরে খেয়ে ফেলছে।’
রাজা সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সিংহের মতো গর্জন দিয়ে বললো, ‘কি, সামান্য একটামাত্র বাঘ আমার রাজ্যের মানুষের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে? আমার এত এত সৈন্য সামন্ত, অস্ত্র গোলা বারুদ থাকতে তুমি এখনো বসে আছো কেন সেনাপতি?’
সেনাপতির খুব ভয়। কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘জাঁহাপনা, বণিক পালোয়ান তো একচড়ে আপনার হাতিটা মেরেছিল। এক চড়ে পাঁচটা মানুষও মেরেছে। তাকে পাঠলে হয় না?’
তাহলে পাঠাচ্ছেন না কেন? রাজা বললেন। বণিক খেয়ে খেয়ে শুধু মোটাই হয়েছে। এখন তার চেহারাটা পালোয়ানের মতোই লাগছে। কিন্তু বাস্তবে সেতো আর পালোয়ান না।
সেনাপতি কিছু সৈন্য সামন্ত নিয়ে গেল বনের ধারে। বাণিককে বললো, ‘এই বনেই কোথাও বাঘটি লুকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে লোকালয়ে ঢুকছে। তুমি এবার বনের ভিতর ঢুকে খুঁজে বের কর। যদি পেয়ে যাও, তাহলে তুলে দিবে এক আছাড়। আমরা এখানেই পাহারা দিচ্ছি। যেন লোকালয়ে ঢুকতে না পারে।’ বণিক ভয়ে ভয়ে ঢুকল বনের ভিতর। কী করবে? উপায় নেই। রাজার হুকুম। ভয়ে বুক দুরু দুরু করছে। বাঘ মারা তো দূরের কথা, সে ভাবছে কী করে বাঘের হাত থেকে রক্ষে পাওয়া যায়। একবার যদি বাঘের সামনে পড়ে যায়, তাহলে আর উপায় থাকবে না। নির্ঘাৎ বাঘের পেটে যেতে হবে। বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটা বিরাট গাছের মগ ডালে উঠে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর চোখের পাতা বুজে এল। ঘুমে একটু ঢলে পড়ল। ঝুল সামলাতে একটা শুকনো ডালে হাত পড়তেই উপর থেকে সাঁ সাঁ সাঁ করে পড়ল নিচে। বণিকের চিৎকারে ছুটে এল সেনাপতি, সৈন্য। এসে দেখে বাঘ মরে শেষ। মানে বণিক যে গাছটায় উঠেছিল সেই গাছের নিচেই বাঘটা কখন এসে ঘুমাচ্ছিল বণিক নিজেও জানে না। পড়বি তো পড় বাঘের উপর। এত উপর থেকে একটা আস্ত মোটা মানুষ পড়লে বাঘ বাঁচে? রাজাতো মহাখুশি। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিভাবে মারলে হে?’
বণিক তার বাহু ফুলিয়ে বললো, ‘আমার দিকে এগিয়ে আসতেই একহাত দিয়ে তুলে মারলাম এক আছাড়। ব্যাচ, এক আছাড়েই কুপোকাৎ।
রাজা খুশি হয়ে বললেন, ‘তোমাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিলাম। তবে দেশে ফিরতে পারবে না। এমন পালোয়ানকে আমি হারাতে চাই না। তোমাকে এ রাজ্যেই থাকতে হবে।’ রাজার হুকুমে বণিকের বাড়িতে চাল, আটা, তেল আর যা লাগে সমস্ত সদাইপাতি পৌঁছে দিল। এভাবে বণিক খায় দায় আর ঘুমায়। আস্তে আস্তে আরও মোটা হয়। একদিন রাজার কানে এল, পাশের দেশের রাজা সৈন্য পাঠিয়েছে রাজ্য দখলের জন্য। রাজা হুংকার দিয়ে বললো, ‘সেনাপতি, শুনলাম রাজা বিক্রম সিংহ আমার রাজ্য দখলের জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে?’
সেনাপতি কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘ঠিকই শুনেছেন জাঁহাপনা। তেপান্তরের মাঠে ওরা তাঁবু গেড়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না জাঁহাপনা। আমাদের বণিক পালোয়ান আছে না, তার বুদ্ধিতেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনার হুকুম থাকলে আজকেই আমরা যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত।’
রাজা বললেন, ‘আজকেই রওনা হতে হবে। ওরা যেন রাজ্যে প্রবেশ করতে না পারে।
তেপান্তরের মাঠে পৌঁছে দেখে ঐ প্রান্তে হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁবু প্রস্তুত হয়ে আছে। বণিক পালোয়ান একহাজার সৈন্যকে কালো পোশাক পরে সাজিয়ে এনেছে। এক হাজার সৈন্যকে হাঁটু গেড়ে ঘোড়া হয়ে বসতে বললো। সকলের মুখে কালি মাখানো। ঠোঁট দুটো গোল করে লাল রং মাখানো। পিছনে একহাজার সৈন্য তীর তাক করে দাঁড়িয়ে। এবার বাণিক পালোয়ান একটা পাগলা ঘোড়ায় উঠে ছুটলো ঐপারে সৈন্যের দিকে। ঘোড়াটা যে পাগলা ঘোড়া ছিলো সেটা কারো জানা ছিল না। বাণিক যতই চেষ্টা করে অন্য দিকে পালিয়ে যাবে ততোই ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটতে থাকে। বণিক পালোয়ান ভয়ে দিশা না পেয়ে একটা তালগাছ দেখে একহাত দিয়ে কষে ধরতেই, তালগাছটা উঠে এল। এবার তাল গাছটা কোলে নিয়ে টগবগিয়ে ছুটছে। ওপারের সৈন্য বলাবলি করতে লাগল, ‘ওরে বাবারে, এই সেই পালোয়ান, যে কিনা একচড়ে একটা হাতি মেরেছে। একচড়ে পাঁচটা মানুষ মেরেছে। এক আছাড়ে একটা বাঘ মেরেছে। আবার একহাতে একটা আস্ত তালগাছ উপড়িয়ে নিয়ে আসছে।’
সেনাপতি বললো, ‘ঐ দেখো সৈন্যরা, ওগুলো কি যন্ত্র ভিড়িয়েছে গো? কালো গোলের মাঝে লাল তার মাঝে সাদা। বাপরে বাপ এমন যন্ত্রতো বাপের জন্মেও দেখিনি। পালা পালা।’
সকলেই পালিয়ে গেল। এভাবে যুদ্ধ না করেও শত্রুদের পরাজিত করলো। রাজাতো মহাখুশি। বণিককে তার রাজ্যের প্রধান সেনাপতি বানিয়ে রেখে দিল তার রাজ্যে। বাণিক পালোয়ানের নাম ডাক একদেশ থেকে আরেক দেশে, এভাবে প্রতিটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সেই থেকে ওই রাজ্যে ভুলেও কোনো রাজা আক্রমণ করার সাহস করে না।