যেন টাইম ট্রাভেল করে এলাম সেই ১০৮ বছর আগের জীবন চিত্রে এলিজা আপুর নির্মিত অসাধারণ এক প্রামাণ্য চিত্র “হরিপ্রভা তাকেদা: এন আনসাং ট্রাভেলার অব বেঙ্গল”। হরিপ্রভা প্রথম বাঙালি নারী যিনি জাপান ভ্রমণ করেছেন। গতকাল শনিবার ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রথম শো হলো। এলিজা আপুর দাওয়াত পেয়ে আমিও গিয়েছিলাম শোটিতে।
১৯১৩ সালে ১০৮ বছর আগে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী, পুরান ঢাকার মেয়ে হরিপ্রভা কিভাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন জাপানে, সেই গল্প উঠে এসেছে এই প্রামাণ্য চিত্রটিতে।
প্রায় ১০৮ বছর আগে ঢাকার হরিপ্রভা তাকেদা জাপানি নাগরিক উইমন তাকেদাকে বিয়ে করে জাপান ভ্রমণে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা করেন ‘বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা’। বইটি প্রকাশ হয় ১৯১৫ সালে। মনে করা হয় বাংলা ভাষায় রচিত জাপান সম্পর্কে এটিই প্রথম বই। ‘বঙ্গ মহিলার জাপান যাত্রা’ সেই সময়ের জাপানের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটের এক অনন্য দলিল। সেই অসামান্য দলিল নিয়েই নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র ‘অ্যান আনসাং ট্রাভেলার অফ বেঙ্গল’।
ঢাকার আগারগাঁওস্থ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর মিলনায়তনে ৯ই অক্টোবর, শনিবার ট্রাভেল ডকুমেন্টারি হরিপ্রভা তাকেদার প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ‘কোয়েস্ট-আ হেরিটেজ জার্নি অফ বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে নির্মিত এ তথ্যচিত্রে হরিপ্রভা তাকেদার জীবনীর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।
২৬ মিনিটের তথ্যচিত্রের এই প্রিমিয়ার শো’তে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। বিশেষ অতিথি ছিলেন- ইতিহাসবিদ ও লেখক ড. মুনতাসির মামুন এবং লেখক-গবেষক, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি সদস্য মফিদুল হক।
প্রিমিয়ার শো’তে আরও উপস্থিত ছিলেন- দীপ্ত টিভি’র সিইও ফুয়াদ চৌধুরী, স্থপতি শামীম আমিনুর রহমান, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ফারুক মইনউদ্দিন, নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলসহ সমাজের আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
প্রধান অতিথি জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সেতু-বন্ধনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরার জন্য এলিজা বিনতে এলাহীকে সাধুবাদ জানান। তিনি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে ও শেষে বাংলায় কথা বলেন এবং পুরো বক্তব্যটি ছিলো হাস্যোরসের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কথা তুলে ধরা।
দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা, পর্যবেক্ষণক্ষমতা—এসব গুণের জন্য মুনতাসীর মামুন হরিপ্রভাকে ঢাকার প্রথম আধুনিক নারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, হরিপ্রভার বাবা শশীভূষণ মল্লিক ও মা নগেন্দ্র বালা। হরিপ্রভা তাঁদের প্রথম সন্তান, যাঁর জন্ম ১৮৯০ সালে।
উয়েমেন তাকেদা ছিলেন রসায়নবিদ। ভাগ্যান্বেষণে প্রথম কলকাতায় আসেন। পরে তিনি ১৯০৩ সালের দিকে ঢাকায় এসে ‘ইন্দোজাপানিজ সোপ ফ্যাক্টরি’ নামে একটি সাবানের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তাকেদা ও হরিপ্রভার বিয়ে হয় ১৯০৬ সালে। ১৯১২ সালের ৩ নভেম্বর তাকেদা ঢাকার কারখানা গুটিয়ে সস্ত্রীক জাপানে চলে যান। হরিপ্রভা তাকেদারা তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারে কলকাতায় যান এবং সেখান থেকে জাহাজে রেঙ্গুন, পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাংহাই হয়ে ১৯১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাপানের পোর্ট মজিতে গিয়ে পৌঁছান। বইয়ে তাকেদা কলকাতা থেকে যাত্রাপথে পড়া প্রতিটি দেশের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। জাপানিরা তাঁকে দেখে খুবই কৌতূহলী হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে অনেক জাপানি আমাকে ব্যগ্র হয়ে দেখিতে লাগিল।’ তাদেকা দম্পতি জাপানে ছিলেন প্রায় চার মাস।
হরিপ্রভা দ্বিতীয়বার জাপানে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে। বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁরা জাপান থেকে ফেরেন। ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন, হরিপ্রভার পরিবার ঢাকা থেকে ভারতের জলপাইগুড়িতে চলে গেছে। ছোট বোন অশ্রুপ্রভার জলপাইগুড়ির বাড়িতেই উঠেছিলেন হরিপ্রভা তাকেদারা। উয়েমেন তাকেদা সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় হরিপ্রভা তাকেদা পরলোকগমন করেন।
হরিপ্রভা তাকেদার উপর নির্মিত এই তথ্যচিত্রের প্রযোজক হেরিটেজ ট্রাভেলার এলিজা বিনতে এলাহী। এই ডকুমেন্টারির কনসেপ্ট, স্ক্রিপ্ট ও গবেষণার কাজটিও তিনি করেছেন। ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন রশিদ বারিকদার। ২০২০ সালে এলিজা বিনতে এলাহী নির্মাণ করেছিলেন আরও দু’টি তথ্যচিত্র; একটি ঢাকার প্রথম আকাশচারী জিনেট ভান তাসেলকে নিয়ে ‘ইন সার্চ অফ জিনেট ভান তাসেল’ অন্যটি ‘আওয়ার রোড টু ফ্রিডম’- যা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো নিয়ে নির্মিত।
এই ট্রাভেল ডকুমেন্টারির উপর ভিডিও বার্তায় জাপান থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন জাপান প্রাবাসী লেখক, গবেষক মঞ্জুরুল হক, জাপানের লেখক ও গবেষক কাজুহিরো ওয়াতানাবে ও জাপানি সাংবাদিক তামামি কাওয়াকামি।
প্রোগ্রাম শেষে দর্শকসারি থেকে অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলাম আমি। অনেক শুভ কামনা এলিজা আপু আপনার জন্য। আপনার আরো কাজ আমরা আগামীতে পাবো আশা রাখি।
-আলেয়া বেগম , সম্পাদক কচিপাতা ম্যাগাজিন

