মা-বাবা শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির দিকটা যতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তার মানসিক বিকাশের দিকটায় তত গুরুত দেন না। কিন্তু‘ শিশুর বিকাশের আছে দু’টি দিক- শারীরিক বৃদ্ধিও মানসিক বিকাশ।
শারীরিক বৃদ্ধি বলতে শিশুর দৈহিক পরিবর্তন ও আকারের বৃদ্ধিকে বোঝায়। আর মানসিক বিকাশ হচ্ছে শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার, বুদ্ধিমত্তা, আচরণ, ভাষার প্রকাশ, বোধশক্তি, অনুভূতি, ভাবের আদান-প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরপর দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়া।
পারিবারিক কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়, তারা হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে। ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১২’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে শিশুর মধ্যে বেশি। মেয়ে শিশুর ১৭.৪৭ শতাংশের পাশাপাশি ১৯.২১ শতাংশ ছেলে শিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গবেষকরা বলেন, ‘শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে।’
প্রতিদিন মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিশুর মধ্যে পরবর্তী কালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের। গর্ভকালে যেসব মা নির্যাতনের শিকার হন অথবা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাঁদের সন্তান ও জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগে। নিউ ইয়র্কের মাউন্টসিনাই মেডিক্যাল সেন্টারের ট্রমাটিকস্ট্রেস স্টাডিজ বিভাগে সম্পন্ন এক গবেষণায় দেখা যায়, মাতৃগর্ভে থাকার সময় যাদের মা মানসিক আঘাতের শিকার হয়ে ছিলেন, সেই শিশুরা সহজেইমানসিক চাপে ভেঙে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অ্যাংজাই টিবাপোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসডিস-অর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষ ভাবে অরক্ষিত ও অসহায়। এসব শিশু পরবর্তী কালে হিং¯্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষন্নতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু।’ শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারে মাকে নির্যাতিত হতে দেখলে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর মা-বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশুর মধ্যে পরম সুখও নিরাপত্তা বোধ জাগায়। বাবাকেও তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে। ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, ‘পারিবারিক নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠা শিশুরা এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে অন্যকে আঘাত করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। সে যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার সেও অন্যের কাছ থেকে আঘাত পেতে পারে। তাই বয়ঃসন্ধি কাল থেকেই তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।’
শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য মা-বাবাকেই নিতে হবে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। মা-বাবা ছাড়া শিশুর চারপাশের পরিচিত মানুষরাই তার বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর আদর, স্নেহ, তার সঙ্গে কথা বলা, খেলা করা, গান-ছড়া-গল্প শোনানো, তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা, আনন্দ দান ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটে। পক্ষান্তর তাকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া, ভয় দেখানো, ধমক দেয়া বা তাকে অবহেলা করা হলে তার আবেগিক, সামাজিক ও মেধাগত দক্ষতার বিকাশ ব্যাহত হয়।
করনীয়:
- ভালো কাজে শিশুকে সব সময় উৎসাহিত কারুন এবংপ্রশংসা করুন।
- শিশুর সামনে পারিবারিক ঝগড়া, অশোভন আচরণ করবেননা।
*পরিবারেরও প্রতিবেশীর শিশুর সঙ্গে আপনার শিশুকে মিশতে দিন এবং খেলার সুযোগ দিন।
- শিশুর সামনে সিগারেট সহ অন্যান্য নেশা করবেন না।
- শিশুকে বিভিন্ন জিনিস, মানুষের সঙ্গে পরিচয় করে দিন। এতে মেধার বিকাশ ঘটে।
- শিশুর ওপর সব সময় কোনো কিছু চাপিয়ে দেবেন না। তাকে পছন্দও দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ দিন। এতে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
- শিশুকে বকা, ধমক, উচ্চস্বরে কথা ও মারবেন না। এতে মেধার বিকাশে বিঘœ হয়।
- শিশুকে প্রচুর সময় দিন। তার সঙ্গে কথা বলুন। শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ছুটিতে শিশুকে বেড়াতে নিয়ে যান। এতে বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে।
- সৃষ্টিশীল বিভিন্ন কাজে শিশুকে উৎসাহিত করুন। এতে মেধারবিকাশ ঘটবে।