প্রতিটি দম্পতির মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু তাদের সন্তানটি। শুধু দম্পতিই-বা কেন প্রতিটি পরিবারের হৃদস্পন্দন পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যটির বুক ধকপকানি সঙ্গে তাল মেলায়। তাদের অফুরান আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন তাকে ঘিরে। ভবিষ্যতে তাদের উপস্থিতিতে বা তারা গত হওয়ার পর হলেও তাদের সন্তানরটির জীবন আশা করে তারা। এর থেকেই শিশুটির প্রতি তাদের যত্নও থাকে যথেষ্ট।
তারপরও সবার ব্যস্ততা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জানার কমতির জন্য শিশুর পুষ্টির ব্যাপারটি যথাযথ হয় না। আবার আজকাল মা-বাবারা বিশেষত মায়েরা প্রায়শই আমাদের কাছে জানাচ্ছেন, তার সন্তানটি ঠিকমতো খাচ্ছে না বা খেতে যাচ্ছে না। এ ব্যাপারেই আমাদের আজকের আলোচনা।
উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত খাদ্য একটি শিশুর জীবনে ৫ বছর বুদ্ধি ও বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় শিশুর মস্তিষ্ক, হাড়, মাংসপেশি, হৃদপিণ্ড ও কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ খুব দ্রুত বাড়ে ও পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। শিশুর খাবারকে মোটামুটি ৩ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রথমত- শর্করা ও চর্বি, দ্বিতীয়ত- আমিষ, তৃতীয়ত- ভিটামিন ও খনিজ দ্রব্যসমূহ। মানে চাল, ডাল, গম ইত্যাদি। এর থেকে আমরা শক্তি পাই। চর্বি অর্থাৎ তেল জাতীয় খাবারে (উচু মানের) দ্বারা আমাদের স্নায়ু কোষ (নিউরন) তৈরি হয়। আমিষ আমাদের মাংসপেশি, হরমোন, এনজাইম, রক্তের হিমোগ্লোবিন ইত্যাদি তৈরিতে অংশ নেয়।
আমিষের অভাবে অপুষ্টিজনিত (পিইএম) অসুখ হতে পারে। ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ আবার দু’ধরনের- পানিতে দ্রবণীয় ও চর্বিতে দ্রবণীয়। চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন হলো ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-ডি। ভিটামিন-এ’র অভাবে আমাদের দেশে এখনও অনেক শিশু রাতকানা রোগে ভুগছে।
কেউ কেউ পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভিটামিন-ডি’র অভাবে অস্থি গঠনে সমস্যা হয় এবং রিকেট নামক অসুখ দেখা দেয়। বাংলাদেশে গত ক’বছরে অনেক শিশুকে রিকেট রোগে ভুগতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে জলে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলো যেমন- ভিটামিন-বি (বি কমপ্লেক্স) ও ভিটামিন-সি’র অভাবে শিশুর রক্তশূন্যতাসহ নানা ধরনের স্নায়ুবিক রোগ হতে পারে।
শিশুর সঠিক গঠন ও পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রতিটি শিশুকে জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শক্ত খাবার দিতে হবে। প্রথম ৫ মাস মাতৃদুগ্ধই যথেষ্ট। কিন্তু ৬ মাসের খাবারের মধ্যে প্রচুর ক্যালরিযুক্ত খাবার থাকতে হবে। শিশুর বয়স এক বছর হলে তাকে দিতে হবে স্বাভাবিক খাবার অর্থাৎ বাড়ির আর পাঁচজন যা খাচ্ছে একই খাবার শিশুরাও খাবে। শতকরা ৯০ জন মা ডাক্তারের কাছে অভিযোগ করেন, আমার বাচ্চা কিছুই খেতে চায় না বা খাচ্ছে না। এ ব্যাপারে প্রত্যেক বাবা-মাকে বুঝতে হবে, শিশুর জিভের ‘টেস্ট বাড’ বড়দের মতোই পরিপূর্ণ। তাকে প্রতিদিন একঘেঁয়ে খাবার দিলে সে খেতে চাবে না।
যদি দুধের সঙ্গে শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়াতে চান তবে প্রথম দিন চালের পায়েস, পরের দিন সেমাইয়ের পায়েস, আর একদিন সয়াবিন বা অন্যদিন কালিয়া দিয়ে, এভাবে স্বাদ পাল্টে খাওয়াতে হবে। সারাদিন বাচ্চাকে অন্তত ছ’বার খাওয়াতে হবে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার ছাড়াও সকালে ও বিকেলে অল্প পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। বিদ্যালয়গামী শিশুদের জন্য টিফিনের খাবারটা একটু ভারি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাচ্চার না খাওয়ার ব্যাপারে একটি কথা বলে রাখা দরকার, বাচ্চা খেতে না চাইলে তার মুখের ভেতর কোন ঘা আছে কি না তা খুঁজে দেখতে হবে। অথবা সর্দিতে নাক বন্ধ রয়েছে কি না। উপযুক্ত খাবারের সঙ্গে বুদ্ধি সহায়ক উপাদান লাগতে পারে কারও কারও। ডাক্তাররা বাচ্চার ওজন, উচ্চতা, বয়স হিসেব করে তা বের করেন। জন্মের সময় যে বাচ্চার ওজন ছিল ৩ কেজি, ৬ মাসে তা দ্বিগুণ ও ১ বছরে ৩ গুণ হওয়ার কথা। এর ব্যতিক্রম হলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে।
আর একটাও ঠিক, আজকালকার বাবা-মায়েরা সচেতন হতে গিয়ে একটু ভুল করে ফেলছেন। তার বাচ্চাটিকে তার বয়স ও উচ্চতার তুলনার বেশি ওজন অর্জন করে ফেলেছে এরই মধ্যেই তার খেয়াল করেন না অনেকেই। আমরা এমন অনেক শিশুকে পাই যার বর্তমান ওজন তার কাক্সিক্ষত ওজনের চেয়ে বেশি। এরপরও তার মা হয়ত অভিযোগ করছেন, তার বাচ্চাটি না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। নাদুস-নুদুস নয়, আমাদের চাওয়া হবে সুস্থ-সবল ও সঠিক হারে বাড়ন্ত শিশু।
আবার শিশুর সঠিক বুদ্ধির জন্য শুধু খাওয়া-দাওয়া দিয়েই চলবে না। তাকে দিতে হবে পারিপার্শ্বিক উষ্ণতা, মানসিক বন্ধন যা কর্মরত মায়েরা অনেক সময়ই হয়ত দিতে পারেন না। আবার কোন কোন মা তার সময় হিসেব করে শিশুকে খাওয়াতে চান। শিশুটি হয়ত সে হিসেব পছন্দ করছে না।
ভাঙা পরিবার, পারিবারিক অশান্তি, বাবা-মার সম্পর্কের প্রতিক্রিয়া শিশুর বুদ্ধির ওপর প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া মানসিক পীড়ন বর্তমান যান্ত্রিক যুগে বাচ্চার বাড়ার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপযুক্ত ক্যালরি, আমিষ ও পারিবারিক বন্ধন দিয়ে যদি দেখা যায় শিশুর বৃদ্ধি আশানুরূপ হচ্ছে না তবে বাচ্চার হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, থাইরয়েড বা যকৃতের কোন সমস্যা থাকতে পারে। তবে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপুষ্টি শিশুর বৃদ্ধির না হওয়ার প্রধান কারণ। আমাদের দেশের জন্য তো বটেই। আমাদের একটি কথা মনে রাখা দরকার, শিশুর পুষ্টি বেশিরভাগই নির্ভর করবে গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির ওপর।
গর্ভাবস্থায় মা যদি অপুষ্টিতে ভুগেন, তবে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির স্থায়ী ক্ষতি সাধিত হবে অর্থাৎ পরে শিশুর পুষ্টির ব্যাপরে যতই নজর দেয়া হোক না কেন, তার খুব একটা উন্নতি হবে না। কেননা শিশুটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হওয়ার মাপঝোক মায়ের পেটেই তৈরি হয়ে যায়।
সব বাবা-মাকে তার শিশুর পুষ্টির ওপর সচেতন ও সঠিকভাবে নজর রাখতে হবে যাতে সমাজ একটি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সবল শিশু পাওয়ার জন্য পরিবারের সব সদস্যদের সচেতন অংশগ্রহণ জরুরি। প্রতিটি পরিবার স্বাস্থ্যবান শিশুর এক একটি বাগান হয়ে উঠুক। তাই তো সমাজ উন্নত হওয়ার পথ পাবে।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
বারডেম একাডেমী, শাহবাগ, ঢাকা