বসন্তকাল এসেছে। চারদিকে পাতা ঝরার কাল। শীত শেষে প্রাকৃতিক ও মনোদৈহিক বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে মানুষ। এরই মধ্যে হাজির হয়েছে ফি বছরের অসুখ জলবসন্ত। কয়েক দশক আগে গুটিবসন্ত মহামারী আকারে দেখা দিলেও এখন আর তা দেখা যায় না।
গুটিবসন্তের হাত থেকে পৃথিবীবাসী রেহাই পেয়েছে ধরে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু নাতিশীতোষ্ণ আরও কিছু অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর বিশেষত শীত শেষে ও বসন্তকালে জলবসন্তে ভুগতে হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষকে।
জলবসন্ত একটি ভেরি সেলা জস্টার ভাইরাস ঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। এটি অনেক মানুষকে খুব অল্প সময়েই সংক্রমিত করে। আক্রান্ত মানুষটি আবার তার চারপাশের মানুষের জন্য জলবসন্তের কারণ হয়। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। ভাইরাসটি একজন সুস্থ বা আপাত সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশের পর ১১ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত কোন রকম শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয়।
এ সময়টিতে আক্রমণকারী ভাইরাসটি দেহে দ্রুত গতিতে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। তারপর শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। প্রথমত অকস্মাৎ জ্বর দেখা দেবে। তার সঙ্গে পিঠ বা কোমর ব্যথা ও গাম্যাজ ম্যাজভাব ও সামান্য মাংস পেশি ব্যথা। কারো কারো মাথায় ব্যথাও হতে পারে। এর দ্বিতীয় দিনে বিশেষ ধরনের গুটি গুটি বা দানার মতো উঁচু অংশ দেখা দেয় প্রধানত বুক ও পিঠে। ক্রমইে এগুলো বড় হয় এবং এর কেন্দ্রে তরল জমা হতে থাকে।
আর এগুলো খুব পাতলা আবরণে আবৃত হওয়ার কারণে সামান্য চাপ বা চুলকানিতেই সেটি গলে যায়। গুটিগুলো ক্রমান্বয়ে মুখমণ্ডল, মাথা, হাত-পায়েও হতে থাকে । এ গুটিগুলো ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে শুকাতে থাকবে। মুখেরও ভেতরে খুব বেশি গুটি হলে খেতে বেশ সমস্যা হতে পারে। মাথার ভেতরে হলেও বেশ সমস্যা হয়। সব ক’টি গুটি গলে যাওয়া পর্যন্ত নতুন গুটি উঠতে পারে।
গুটিগুলো শুকানোর সময়টা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়টাতে আক্রান্ত মানুষ থেকে আশপাশের মানুষকে সহজেই আক্রান্ত করতে পারে। তাই এ সময়টা রোগীসহ কাছের মানুষ কেউ বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। আর এ সময়টাতে বেশ চুলকাতে থাকে। চুলকানি আগে শুরু হলেও এ সময়টাতে সবচেয়ে বেশি থাকে। আর চুলকালে সেখানে স্থায়ী দাগ হয়ে থাকে। তাই চুলকানো থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। মুখমণ্ডলে গুটি দেখা দিলে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
জলবসন্ত সাধারণত খুব ভয়াবহ হতে দেখা যায় না। তবে যেসব শিশু-কিশোর বা বয়স্ক মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে বা ওষুধ দিয়ে রোগ প্রতিরোধক কার্যকারিতা দমিয়ে রাখা হয়েছে; তাদের ক্ষেত্রে এটি জটিল হতে পারে। কারো কারো গুটি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
এ ভাইরাসটি নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস মস্তিষ্কে প্রদাহ, কিডনির প্রদাহ, ত্বকের প্রদাহ, অস্থি সন্ধির প্রদাহ ইত্যাদি হয়ে থাকে। গর্ভবতীদের জলবসন্ত হলে নবজাতকটি জন্মগত আঙ্গিক ত্র“টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। জলবসন্ত হলে ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করার বা এর দ্বারা সংঘটিত শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে প্রশমনের মতো কোন ওষুধ আমাদের হাতে নেই।
শুধু উপসর্গগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতে হবে। চুলকানি দমাতে এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। আর যদি ২য় কোন ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোন পরজীবীর সংক্রমক ঘটে তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। মুখমণ্ডল বা শরীরে দাগ হওয়া থেকে রক্ষা পেতে হলে আঙুল দিয়ে খুটাখুটি থেকে বিরত থাকতে হবে। অসুখ সেরে যাওয়ার পর ডাবের জল দিয়ে মুখ ধুলেও দাগ তাড়াতাড়ি শুকাতে পারে।
জলবসন্তের টিকা নেয়াটা জরুরি। বিশেষত কম বয়সীদের। কেননা তারাই সবচেয়ে বেশি শিকার হয় জলবসন্তের। আর আক্রান্ত লোকটিকে মশারির ভেতরে থাকতে হবে দিন-রাত। এতে অন্যান্য মানুষ জলবসন্তের হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। বছরের শেষ শীত বা বসন্তকালটা এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৭৪৫৯৯৯৯৯০-৩, ০১৯১৯০০০০২২