হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি অতি পরিচিত রোগ যা ফুসফুসের বায়ুনালীর মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি। আমরা যখন নিঃশ্বাস নেই তখন বাতাস শ্বাস-নালীর বিভিন্ন শাখা প্রশাখা দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে তারপর বেরিয়ে আসে। হাঁপানী রোগীর ক্ষেত্রে বাতাস চলাচলের এই পথগুলি বিভিন্ন কারণে সংবেদনশীল হয়ে সরু হয়ে পড়ে ফলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
এখন গরমের মৌসুম তাই হাঁপানি আক্রান্ত শিশুরা বেশি সংকটের সম্মুখীন। আমাদের দেশে হাঁপানি চিকিৎসায় এখনও অনেক কুসংস্কার রয়েছে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কিছু অসাধু প্রতারক ব্যক্তি হাঁপানিকে তাবিজ, মাদুলী দিয়ে গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে থাকে ফলে অশিক্ষিত, সহজ, সরল মানুষেরা সুচিকিৎসার আলো দেখতে পায় না বরং অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
হাঁপানিতে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায় প্রধানত তিনটি কারণে
১। বিভিন্ন রোগ জীবাণুর সংক্রমনে শ্বাসনালীর ভিতরের স্তরে প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন হয়ে ফুলে উঠে।
২। শ্বাসনালীর চারপাশের মাংসপেশী সংকোচিত হয় ফলে বাতাস চলার পথ সরু হয়ে যায় একে বলা হয় ব্রংকোকনস্ট্রিকশন।
৩। উত্তেজক পদার্থের প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে প্রচুর পরিমাণে মিউকাস জাতীয় আঠালো কফ নিঃসৃত হয়ে শ্বাসনালীতে জমা হয় ফলে বাতাস চলাচলের পথকে আটকে দেয় যার ফলে অল্প বাসাত সরু শ্বাসনালী দিয়ে প্রবাহের সময় শ্বাসের সাথে সাঁই সাঁই আওয়াজ হয়।
অনেক কিছুতেই হাঁপানির আক্রমণ শুরু হতে পারে যেমন- বাড়ি ঘরের ধুলো-ময়লায় থাকা মাইট, উগ্র গন্ধ , সিগারেট বা অন্যান্য ধোঁয়া, পরাগ বা ফুলের রেনু, পশুপাখির পালক, লোমস, খেলনা, ছত্রাকের স্পোর, আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঠান্ডা লাগা, বিশেষ কিছু খাদ্য, কিছু কিছু ওষুধ যেমন- এস্পিরিন, পেনিসিলিন ইত্যাদি, শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত কোন কোন রাসায়নিক পদার্থ, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম ইত্যাদি।
আজকাল দূষিত বাতাস গ্রহণের জন্য শিশুদের মধ্যে হাঁপানির প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে, শিশুরাই এখন হাঁপানিতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি অ্যাজমা দেখা যায় এলার্জিক কারণে। এ অ্যাজমা সাধারণত শিশুকাল থেকেই শুরু হয় এবং রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় থেকে বা বংশানুক্রমে চলতে থাকে। পিতৃকুলের চেয়ে মাতৃকুল থেকে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা প্রায় তিনগুণ বেশি থাকে।
কতগুলো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখে অ্যাজমা আক্রান্ত শিশু চিহ্নিত করা যায় যেমন বুকে আঁট সাঁট, দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা, শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কণ্ঠ অনুভব করা, বুকের ভিতর বাঁশির মত সাঁই সাঁই শব্দ হওয়া। ঘন ঘন শুষ্ক কাশি, গলার নিচের অংশ এবং দুই পাঁজরের নিচের ও মধ্যবর্তী অংশ শ্বাস নেয়ার সময় ভিতরে ঢুকে যাওয়া, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে না পারা এবং ঘুম থেকে উঠে বসে থাকা, সর্দি লাগার পর শ্বাস কষ্ট অনুভব করা। এসব উপসর্গ সাধারণত রাতে বৃদ্ধি পায়।
হাঁপানির চিকিৎসায় নানা রকম ওষুধ রয়েছে। তবে ইনহেলারের মাধ্যমে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়। সাধারণত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়- দ্রুত আরামদায়ক ওষুধ বা ব্রংকোডাইলেটর যা শ্বাসনালীর সংকোচন রোধ করে দ্রুত শ্বাস কষ্ট লাঘব করে যেমন- সালবিউটামল, টারবিউটালিন, থিওফাইলিন ইত্যাদি।
শ্বাসনালীর প্রদাহ নিরাময়ে প্রতিষেধক বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। প্রতিষেধক ওষুধগুলি ধীরে ধীরে কাজ করে এবং শ্বাসনালীর সংকোচন ও প্রদাহ থেকে শ্বাসনালীকে রক্ষা করে। প্রতিষেধক ওষুধগুলি হাঁপানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এগুলি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় না, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও কম ফলে বহু বছর ব্যবহার করা যায়। আজকাল আমাদের দেশেও অ্যাজমার অত্যাধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। ওষুধের পাশাপাশি ভেকসিন দিয়ে রোগীকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখা সম্ভব হয়।
এক একটি বাচ্চা আলাদা আলাদা ট্রিগার বা উত্তেজকের প্রতি সংবেদনশীল। বাচ্চার যদি হাঁপানি থাকে, তাহলে বাচ্চার হাঁপানির ট্রিগার গুলি চিনে নিয়ে সেগুলি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি।
হাঁপানি আক্রান্ত বাচ্চার পিতামাতার ধুমপান করা উচিত নয় কারণ সিগারেটের ধোঁয়াও শিশুর উত্তেজক হিসাবে অ্যাজমার কারণ হতে পারে। শিশুর হাঁপানির উপর খাবারের প্রভাব আছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি দেখা যায় বিশেষ কোন খাবার খেলে বাচ্চার হাঁপানির আক্রমণ হয় তবে ঐ সব খাবার শিশুকে খেতে দেয়া যাবে না। হাঁপানি ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি সর্দি কাশির মত নয়, একজনের হলে অন্যজনের মধ্যে ছড়াবে না। অ্যাজমা আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খেলে শিশুর অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা নেই। এটি বংশগতভাবে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ডাক্তারের পরামর্শমত চললে এবং চিকিৎসা করলে হাঁপানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং আনন্দময়, কর্মক্ষম জীবন যাপন করা যেতে পারে। অনেকদিন ধরে নিয়মিত চিকিৎসা করালে বাচ্চার যে সব সুফল পাওয়া যাবে তা হলÑ হাঁপানির লক্ষণগুলি একেবারে চলে যাবে, বড় জোর দিনের বেলায় সামান্য লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কোন কষ্ট ছাড়াই রাত্রে বেলায় শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। কখনও লেখাপড়ার সমস্যা হবে না। শারীরিক কাজ কর্মে কোন ব্যাঘাতও হবে না।
বাচ্চা স্কুলে গেলে তার হাঁপানির সমস্যা শিক্ষককে জানান, বাচ্চার হাঁপানির লক্ষণগুলি নিয়ে শিক্ষকের সাথে আলোচনা করুন। স্কুলে বা ভ্রমণকালে বাচ্চার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সঙ্গে রাখুন। বাচ্চাকে সব সময় পরিস্কার থাকতে উৎসাহিত করুন। ওকে ধুলোবালি, জীবজন্তু, লোমশ খেলনা দিয়ে খেলতে বারণ করুন, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাচ্চাকে সাধারণ ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করুন।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৭৪৫৯৯৯৯৯০-৩, ০১৯১৯০০০০২২