মায়ের কোনো প্রকার বা বিশেষণ হয় না।সে পাগলি হোক বা সুস্থ স্বাভাবিক হোক একজন মা শুধুই মা। তার মধ্যে কোনো বিভেদ বা পার্থক্য নেই। একজন মা-ই বুঝতে পারে সন্তান জন্ম দেয়ার মাহাত্ম। সম্প্রতি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সালমার মা হওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় অনেকে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন মা ও সন্তানের জন্যে।
সেদিনের ঘটনাটি ঠিক এ রকম- জেলার শিবচর উপজেলার পৌর এলাকার হাতিরবাগান মাঠের বালুর মধ্যে একটি শিশুর জন্ম দেয় মানসিক ভারসাম্যহীন এই সালমা। তাকে গত সাত আট মাস ধরেই শিবচরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত কিন্তু তাকে দেখে কখনো অন্তসত্ত্বা মনে হতো না। সেদিন রাতে হঠাৎ করেই নারীর চিৎকার ও সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর কান্নার শব্দে কয়েকজন যুবক অন্ধকার লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলে মানসিক ভারসাম্যহীন নারী সালমাকে সন্তান প্রসব দেখতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি করে স্থানীয় কয়েকজন নারীর সহায়তায় তাকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মা সন্তান সুস্থ হন।
তারপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। অনেকে শিশুটির জন্য মায়া কান্না করেন। কেউ বলে এই নবযাতকের ভবিষ্যৎ কি হবে? তাকে দেখবে কে? খাওয়াবে কে? কোন পরিবেশে বড় হবে? সেও কি তার মায়ের মত পাগলী হবে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো কোনো মানুষ বা সেচ্ছাসেবি সংগঠন সেই পাগলীর কি হবে তা বলল না। পাগলীকে সুস্থ করার কথা চিন্তা করল না। কেউ বলল না যে যদি পাগলী আজ সুস্থ পরিবেশে থাকতো তাহলে আজ রাতের অন্ধকারে চরের বালির মধ্যে সন্তানটি ভূমিষ্ট হতো না। আর এখন যারা সন্তানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব মাথা ব্যথা করছেন তাদেরকে আর মাথা ব্যথা করতে হতো না। পরিস্থিতিটি গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মতো মনে হচ্ছে। অথবা বাঁশ কেটে কঞ্চির জন্য মায়া কান্না করা হচ্ছে। তবে সন্তানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করাটা দোষের কিছু নয়, তবে কিছুটা বেমানান বটে। কারণ আমাদের সমাজের সমস্যাগুলো গোড়া থেকে সমাধান করা না গেলে একের পর এক বালিতে পাগলী সামলার সন্তান প্রসব করার মতো ঘটনা অহরহ ঘঠবে। তবে এমন সময় এগিয়ে এসেছেন একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের বন্ধু ব্যাংকার শামীম আহমেদ এবং তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কচিপাতার সম্পাদক আলেয়া বেগম আলো।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার শামীম আহমেদ মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় অযত্ন-অবহেলায় রাস্তা ঘাটে পড়ে থাকা ঠিকানাহীন মানুষকে নিজ উদ্যোগে হাসপাতালে ভর্তির মাধ্যমে, সেবা শুশ্রুষার মাধ্যমে ভালো করে ও ঠিকানা খুঁজে বের করে স্ব স্ব বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে বান্দরবান জেলার থানচিতে কয়েকজন অফিস সহকর্মীদের সাথে বেড়াতে গিয়ে থানচি বাজারে মানসিক ভারসাম্যহীন এক তার খুব মায়া হয়। তারপর ঢাকায় এসে প্ল্যান করেন, কিভাবে মেয়েটিকে থানচি থেকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করে সুস্থ করা যায়। বিষয়টি আমার সহকর্মী আলী সাব্বির ও সাব্বিরের আরেক বন্ধু হাসান ফরহাদ আজাদকে সঙ্গে নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত অন্তর, আদুরী, রানী, কোহিনূর ও সাহিদা নামের এ ৫জন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে সুস্থ করে নিজ বাড়িতে ফিরিয়েছেন। পারুলীর নামের আরেকটা মেয়ের পরিবারে খোঁজ না পাওয়ায় শামীম আহমেদ পারুলীর ভরণ পোষণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি মাসে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাওয়া মেয়েগুলোর জন্য ঔষধ নিজ খরচে পাঠিয়ে দেন।
শামীম আহমেদ সম্প্রতি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে বান্দরবান জেলার থানচী থেকে আমাদের যাএা শুরু। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন অফিস কলিগদের সাথে থানচীতে ঘুরতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমি মেয়েটিকে একটি তেতুল গাছের নিচে দেখতে পাই। মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন (আমরা যাদেরকে পাগল বলি)। মেয়েটিকে থানচীতে দেখে আসার ৩ মাস পর অর্থাৎ ২০১৫ সালের মার্চ মাসে পুনরায় ঢাকা থেকে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে থানচীতে গিয়ে মেয়েটিকে ঢাকায় নিয়ে আসি এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্হ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্ত্তি করাই। মেয়েটি সুস্থ হবার পর ফেসবুক ও পোস্টারিং এর মাধ্যমে মেয়েটার বাড়ি খুঁজে বের করে মেয়েটির পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। আমি মেয়েটির নাম দিয়েছিলাম “অন্তর”। তবে তার আসল নাম শিউলী রাণী সরকার, স্বামী: ফালান সরকার, ২জন ছেলে ও ১জন মেয়ে আছে। সে ৫ বছর আগে তার বাড়ি থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় হারিয়ে গিয়েছিল। তার বাড়ি ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার দাউরিয়া গ্রামে। অন্তর (শিউলী রাণী সরকার) বর্তমানে তার স্বামী, ২ ছেলে, ১ মেয়েকে নিয়ে সংসার করছে।
এবার সালমা পাগলীকে সুস্থ করার মিশনে নামছেন শামীম আহমেদ। এ প্রসঙ্গে তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন-
‘ইনশাআল্লাহ, আমরা যাচ্ছি শিবচরে সেই পাগলি মাকে সাহায্য করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, কিছুক্ষন আগে Jahid Hasan Ome এর সাথে কথা হলো। গত ২ দিন যাবৎ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে অবশেষে আমার এক প্রবাসী ফেসবুক বন্ধু গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই সওকত আলীর মাধ্যমে অমির ফোন নাম্বার যোগাড় করি। এই সেই অমি যারা রাস্তায় পড়ে থাকা এক পাগলিকে রাস্তায় বাচ্চা প্রসব করার সময় মা ও বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয়, মানসিক ভারসাম্যহীন মা ও বাচ্চাকে সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করে যাচ্ছে। আমরা ২ জন প্রায় ১৫ মিনিট কথা বলেছি। তাছাড়া কথা হয়েছে মাদারীপুর জেলা পরিষদের মেম্বার শাহারিয়ার হাসান খান রানা ভাইয়ের সাথে। ইনশাআল্লা খুব শীঘ্রই আমরা শিবচরে যাবো ও পাগলিকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসবো। আমাদের সাথে থাকবে অমি ও তার বন্ধুরা। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
হুমায়রাকে নিয়ে যমুনা টিভির সংবাদ শামীম আহমেদের টাইমলাইন থেকে:
কয়েকজন মহৎ যুবক
ঘটনার দিন স্থানীয় হাতিরবাগান এলাকার বালুর মাঠে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন সালমা পাগলি। তখন অমি, সাগরসহ স্থানীয় কিছু যুবক মাঠে আড্ডা দিচ্ছিলেন। শিশুর কান্নার শব্দ পেয়ে এগিয়ে যান তারা। মোবাইলের আলোয় দেখতে পান এক ফুটফুটে নবজাতক। পাশে সেই নারী অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছেন। তারা আশপাশের বাড়ির মহিলাদের ডেকে আনলে তারা বাচ্চাটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। এরপর দু জনকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের কর্তকর্তারা, স্থানীয় নের্তৃবৃন্দ ও উৎসুক জনতা হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকে মা-সন্তানকে আর্থিকভাবে সহযোগিতাও করেন। শিশুটির নাম রাখেন জান্নাতুল হাবিবা হুমাইরা। নবজাতক ও মাকে বালুর মাঠ থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জাহিদ হাসান অমি গত বৃহস্পতিবার ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেন, ‘প্রিয় মামা অবশেষে তোমার নাম ঠিক করলাম আমি ও লিটু। এই রাত ২টা ৩৫- এ। ভাবতে ভাবতে খুব সুন্দর একটি নাম তৈরি করলাম। জান্নাতুল হাবিবা নূরে (হুমায়রা)।”
অমির ফেসবুক লাইভ:
ফেসবুকে মাধ্যমে অমি এবং তার বন্ধু ইব্রাহীম ও সাগরের প্রশংসা করছেন অনেকেই। কারণ তাদের মত মহৎ যুবকরা এগিয়ে না এলে হইতো নবযাতক হুমায়রাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। আবার অনেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও জানিয়েছেন। একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী নবজাতক ও মায়ের ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘পাগলিটা মা হলেন, বাবা হলেন না কেউ’
হাসপাতালে হুমায়রার সঙ্গে অমি
হুমায়রাকে দত্তক নিলেন চট্টগ্রামের এক সরকারি কর্মকর্তা
অমির ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায় ইতমধ্যে হুমায়রাকে নেয়ার জন্য ৫০০ এর ও বেশি মানুষ আবেদন করেছেন। তবে প্রশাসন নানা দিক চিন্তাভাবনা করে কন্যা শিশুটির ভবিষ্যৎ ও তার মায়ের চিকিৎসার কথা বিবেচনায় রেখে উচ্চবিত্ত পরিবারের কাছে শিশুটিকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। মানসিক ভারসাম্যহীন সালমার গর্ভে জন্ম নেয়া কন্যাশিশু হুমায়রাকে দত্তক নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন চট্টগ্রামের এক সরকারি কর্মকর্তা। গত শনিবার রাতে প্রশাসনের সহযোগিতায় তাঁর হাতে শিশুটির দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। তবে শিশুটির দায়িত্ব নেয়া দম্পতি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তাঁদের নাম প্রকাশ ও ছবি না দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। পরে চট্টগ্রামের এক নিঃসন্তান সরকারি কর্মকর্তা শিশুটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আসেন। তবে পুলিশ হুমায়রার আসল বাবাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ব্যাংকার শামীম আহমেদ ও তাঁর টিম ওই ভারসাম্যহীন নারীকে ঢাকা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ব্যাপারে দায়িত্ব নিয়েছেন। কন্যাশিশুটির দায়িত্ব নেয়া দম্পতি জানান, তাদের পরিবারে সব আছে। কিন্তু আমাদের সংসারে আলো নেই। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পরেও কোনো সন্তানের বাবা হতে পারেননি তিনি। তবে এবার এই সন্তানের বাবা হতে পেরে খুব ভালো লাগছে। সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছেন।
হুমায়রাকে বিদায় দেয়ার সময় কান্নায় ভেঙেগ পড়েন অমি। তিনি তাঁর ফেসবুখে লিখেছেন:
ছিল না রক্তের বন্ধন কিন্তু মা হুমায়রা তুই মোরে করে গেলি এতিম
*যেখানেই থাক ভাল থাকিস মা হুামায়রা…..
মায়ের কোনো প্রকার বা বিশেষণ হয় না।সে পাগলি হোক বা সুস্থ স্বাভাবিক হোক একজন মা শুধুই মা।
[…] […]