সকাল থেকে মাথায় কিলবিল করছে “গন্তব্যহীন যাত্রা” নামক গল্পটা। আমাদের সমাজের গৃহশ্রমিকদের নিয়েই হবে গল্পটা। অভাবের তাড়নায় শহরে এসে অনেক সময় ওরা পা বাড়ায় গন্তব্যহীন পথে। লেখাটা পুরোই মাথায়। অক্ষরে বিন্যাস করার জন্যে অপেক্ষা করছি। ভাবনার মাঝে সাজিয়ে নিচ্ছি প্রথমটুকু। কিন্তু ভাবনা বারবার ছুটে যাচ্ছে অভ্র আর অর্পিতার কথার কারণে।
মাত্র মিনিট ৫/৭ হয়েছে ওরা ঘরে ঢুকেছে। দুজনেই পড়ে এবার ৭ম শ্রেণিতে। আমাদের সময়ে টিনএজ এর সময় আরো পরে হলেও এখনকার বাচ্চাদের সময় অনেক এগিয়ে। অভ্র আর অর্পিতা এখন কিশোরী বয়স পার করছে। সেই প্লে ক্লাস থেকে ওরা একসাথে পড়ে। কিন্ডারগার্টেন-এ যেমন ছিলো প্রিয় বান্ধবী, স্কুলে এসেও তাই। স্কুলের প্রায় সবাই জানে এরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড। এই সূত্র ধরে অর্পিতার আম্মু আর আমিও খুব ভালো বন্ধু। প্রতিদিন ওদের স্কুল ছুটি হয় বেলা একটায়। কিন্তু বিশেষ কোন কারণ থাকলে নোটিশ বোর্ডে ছুটির সময় দেয়া হয়। আজ স্কুল ছুটি হয়েছে দুপুর ১২টায়। অর্পিতার বাবা ওকে স্কুলে দিয়ে যাবার সময় নোটিশ বোর্ড দেখেনি। তাই জানে না কখন ছুটি হবে। অর্পিতাকে নিতে আসবে ওর মা। ওর বাবা নোটিশ বোর্ড দেখলে ওর মাকে কল করে ছুটির সময় জানিয়ে দিত। স্কুল ছুটির পর মাঠে মাকে দেখতে না পেয়ে অর্পিতা অভ্রর সাথে বাসায় চলে আসে। অভ্র আগেই জানে আজ আমি ওকে আনতে যাব না।
কলিংবেল বেজে উঠলে ওদের দরজা খুলে দিয়ে নিজের ভাবনায় বসি। ওরা দুইজন গিয়ে বসে অভ্রর পড়ার ঘরে। আমি ড্রয়িংরুমে আর ওরা পাশেই বেডরুমে। খুব স্বাভাবিক আওয়াজেই কথা বলছে ওরা। একেবারেই নিজেদের কথা, নিজের কথা। অর্পি বলে অভ্র শুনে, আবার অভ্র বলে অর্পি শুনে। ওদের আজকের আলোচনার বিষয় নিজেদের পরিবার, ভাই বোন আর পরিবার থেকে পাওয়া ওদের ভালোবাসা। আমার দুই সন্তান, দুজনেই মেয়ে। অভ্র আমার ছোট মেয়ে। ওদের দুইবোনের বয়সের ব্যবধান ৭বছরের। অর্পিতারা ৩ভাইবোন। দুইভাই বড়, অর্পিতা ছোট। তিনজনের বয়সের ব্যবধান ৭বছর করে। অভ্র নানা বাড়ির দিক থেকে এই প্রজন্মের ২য় আর দাদা বাড়ির দিক দিয়ে ৫ম হবে। অন্য দিকে অর্পিতাদের অনেক বড় পরিবার। বাবা চাচা হলো ৮জন, মা মামা খালারা ১০জন। সে হিসাবে ওদের পরিবারে অনেক সদস্য।
গত ৬মাস আগে অর্পিতার ইমিডিয়েট বড়ভাই অয়ন দেশের বাহিরে যায় লেখাপড়া করতে। অয়নের সাথেই ছিল অর্পিতার ভাব বেশি। দুই ভাইবোন একসাথে কাটানোর সময় পেয়েছে অনেক। অয়নও ছিলো ঘরোয়া, মা বোনের সাথেই সময় কাটাতো বেশি। বড়ভাই মিতুল এখন চাকরি করে। লেখাপড়া আর অল্প বয়সে চাকরিতে প্রবেশের কারণে অয়নের সাথে যতটা মিতুলের সাথে ততটা সময় পায়নি অর্পিতা। অয়ন চলে যাবার পর অর্পিতা অনেক একা হয়ে যায়। এই একাকিত্বের কথা সে তেমন কাউকে বলে না অভ্র ছাড়া। সেদিন অভ্র আমায় বলে-
– জানো মা, অর্পিতা প্রতি রাতে কান্না করে অয়ন ভাইয়ার জন্যে। কিন্তু ও আন্টিকে কিছু বলে না।
অভ্রকে বলেছি…
– কি করার আছে বলো, লেখাপড়ার জন্যেই তো গেছে। তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো, সময় পেলেই যেন ভাইয়ার সাথে কথা বলে।
বিষয়টা অর্পিতার আম্মুকে ও জানাই, জেনো মেয়েকে আগের চেয়ে একটু বেশিই সময় দেয়।
আজকের কথায় অর্পিতা বলে
-তুইতো সারাক্ষণ বোনকে পাশে পাচ্ছিস। একসাথে ঘুমাচ্ছিস, কত গল্প করিস, আমি আগে সব বলতাম অয়ন ভাইয়ের সাথে। এখন কাউকে বলতে পারি না। অয়ন ভাইয়া অনেক ভালোবাসতো আমায়, মিতুল ভাইয়াও ভালোবাসে, জানিস প্রতিদিন বাসায় আসার সময় মিতুল ভাইয়া আমার জন্যে পছন্দের চকলেট নিয়ে আসে।
– আমি জানি ভাইয়া ও আমায় অনেক ভালোবাসে, তবে অয়ন ভাইয়ার মতো না। আমার যদি একটা বোন থাকতো। বোন নেই তো নেই ভাইয়াও চলে গেলো।
– তুইতো একাই। আমার হয়েছে অন্য, আপু যখন হয়েছে তখন পরিবারে আর কারোই বাবু ছিল না সব্বাই আপুকে অনেক বেশি ভালোবেসেছে আর আমাকে কম।
– আরে দূর, তোকেও ভালোবাসে, তুই এই সময়ে যা পাচ্ছিস রৌদ্র আপু কিন্তু কিছুই পায়নি।
– আমি অনেক কিছু পেয়েছি, যা আপু পায়নি। আবার আপু মানুষের ভালোবাসা বেশি পেয়েছে যা আমি পাইনি। এই দেখ আপু যখন ছোট ছিলো আম্মু সারাক্ষণ ওকে নিয়েই ছিলো। আর আমি যখন হলাম আম্মু সকাল দুপুর আপুকে নিয়ে স্কুলে যায় প্রাইভেট এ যায় আমি হয় বুয়ার কাছে থাকতাম। না হয় পাশের বাসায় রেখে যেতো।
– বুঝিসনা কেন, তোকে নিয়ে গেলে তো আন্টির কষ্ট হতো, তোর ও হতো। তুই বড় হওয়ার পর তো তোকে নিয়েই যেতো, অর্পিতার কথা।
অভ্র আবার অন্য কথা বলে,
– জানিস আপুর অনেক খেলনা ছিলো, আমি সব নষ্ট করেছি। মাঝে মাঝে আপু এখন আমায় অনেক বকাও দেয়।
– বড়রা এমনিইরে অভ্র।
– হা হা হা, আপুর ১০সেট খেলনা ছিলো, আমি ভেঙ্গে আর হারিয়ে এক সেট বানিয়েছি। জানিস আপুটা আমায় শুধু কাজের অর্ডার দেয়, নিজে খুব অলস। আম্মু অসুস্থ থাকলেও কিচ্ছু করে না, আমাকে করতে হয়। একবার আম্মু খুব অসুস্থ, শুধু লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। সকালে আব্বু আর আপু চলে যেতো, আমি সারাক্ষণ আম্মুর চারপাশে খেলতাম, ঐ টুকুন আমি আবার বিছানা পেতে গুছাতাম। বুয়া আসলে দরজা খুলে দিতাম, আবার গেলে বন্ধ করতাম। মায়ের চারপাশে খেলনা ছড়িয়ে রাখতাম।
– একই অবস্থা আম্মুরও, তবে আম্মু অসুস্থ থাকলে অয়ন ভাইয়া সব কাজ করে।
ওদের কথাগুলো পাশের রুম থেকে আমি শুনছি তা তারা খেয়াল করেনি। নিজেদের
মতো বলেই যাচ্ছে। অভ্র এক সময় মতোঅর্পিতাকে কড়া ভাষায় বলে,
— তুই একটা গাধা, ভাইয়েরা কত কি পারে, করতেও চায় আর তুই কিচ্ছু করতে চাস না।
– তা ঠিক বলেছিস, ভাইয়ারা খেলাধুলো করতো অনেক। অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিত, পুরস্কারও পেতো। আম্মু মাঝে মাঝে বলে আমি কিচ্ছু পাইনি। তুই তো ভালোই পারিস। গল্প লিখতে পারিস, বইও বের করেছিস। আবার সেদিন নকশিকাঁথা সেলাই প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছিস। আসলে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
– হবে না মানে, হবে। আমি বলছি হবে। আন্টি তোকে গান শিখায়। তুই মন দিয়ে শিখলেই হয়। যেদিন তুই চ্যানেল আইতে গান করেছিস আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার খুব ইচ্ছে করে ভায়ওলিন শিখতে কিন্তু বাবা দিবে না। বাবা বলে, চাইলে গান শিখতে পারো। কিন্তু আমার ভালো লাগে না। আম্মু তো একপ্রকার জোর করেই আর্ট-এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
-ঠিক করেছে। এই যে কত সুন্দর আঁকতে পারিস।
-তুই ও তো আঁকতে পারিস।
হঠাৎ করেই ওদের কথার বিষয় পালটে যায়। আমাদের দেশের একটা প্রচলন আছে, তা হলো অনেক পরিবারের মুরুব্বীরা মনে করে বাচ্চারা তাদের নানা নানী বা মামা খালাদের বেশি ভালোবাসে চাচা ফুফুদের চেয়ে। এখন ওদের কথার বিষয় তাই। অভ্রর বাবা মাঝে মাঝে এমন বলে, অর্পিতার বাবা না বললেই কিছু সময় ব্যবহারে তা প্রকাশ পায়। অর্পিতার চাচা মামা অনেকেই আশেপাশে থাকে, তাদের সাথে উঠা বসা হয়। দেখা যায় প্রতিদিন কেউ না কেউ বাসায় আসে, তাদের সাথে পারিবারিক কথা হয়। ছবি তুলে ফেইসবুকে দেয়। অভ্র দেখে আর ভাবে ওর কেনো এমন হয় না। একটা মাত্র খালা, উনার আবার বাচ্চা নাই। বড় মামার দুই ছেলে, তারাও দেশের বাহিরে।
ছোট মামাদের এখনো বাবু হয়নি। তবে ৩/৪ মাস পর হবে। অভ্রর এখনিই অনেক ভাবনা, সে বাবু হলে কি কি করবে। ছুটি পেলেই মামার বাসায় চলে যাবে। চাচুর একটা মাত্র ছেলে, ওরাও থাকে উত্তরা। সহজে দেখা হয় না।
বাসায় কে আসলে কেমন লাগে, অনেক সময় বড়দের ইচ্ছামতো অন্যদের সাথে গল্প করতে হয়, তা তাদের ভালো লাগে না। কথা বলতে বলতে অভ্র বলে কিছুদিন পর তোর ভাইয়েরা বিয়ে করলে তোদের আরো কত লোকজন হবে। আর আমার তো আপুর বিয়ে হলেই চলে যাবে। অর্পিতা বলে,
– আরে দূর, তখন তো আমরাও বড় হয়ে যাব।
– তার মানে এখন ছোট, হি হি হি।
হি হি হি করে ওরা খুব আস্তে কিছু একটা বলে। আমি পুরো শুনতে পাই না। তবে আমি বুঝি ওরা কি বলছে।
পরিবারের কার আচরণ কেমন লাগে তা নিয়েও ওরা কথা বলে। ওদের মনে কথাগুলো স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে আসে, ওরা এইভাবে বড়দের সাথে বলতে পারে না। আমার সন্তÍানদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি ওদের সাথে অনেক ফান করি। তবুও আমি ওদের অমন বন্ধু হতে পারি না। বড় মেয়ে রৌদ্র আগে ডায়রি লিখতো। ও লিখেছে,
– মা আমার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করে এটা ঠিক। তবে মা এটা বুঝে না সব সময় এমন বন্ধুত্ব ভালো লাগে না। মা সব সময় উপদেশ দেয়, ভালো ভালো কথা বলে, সব সময় ভালো চাই ভালো চাই বলে। কিন্তু অন্য বন্ধুরা যারা সমবয়সী তারা এমন নয়। তারা অন্যরকম। তারা এত জ্ঞান দেয় না, ফান করে হাসাহাসি করে। ভালো লাগে। আমি জানি আম্মু ভালো চায় বলেই এমন করে, তবে এটা বুঝে না আমার এত ভালো লাগা ভালো, ভালো ভালো লাগে না।
সেদিন রৌদ্রকে কিছুই বলিনি, সময় করে বুঝিয়েছি। এখন অভ্র বড় হচ্ছে, আমি দেখি অভ্র আমার সাথে যখন যা বলে তার আগেই রৌদ্রকে বলে। আমায় বললে আমি রৌদ্রর সাথে বলতে গেলেই রৌদ্র বলে,
– আমি জানি, ও আমাকে বলেছে।
আজ অভ্র আর অর্পিতার অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে পারলাম। ওদেরকে এমন করে আড্ডা দেয়ার পরিবেশ করে দেয়া আমাদের উচিৎ। ওদের মনের না বলা কথাগুলো বেরিয়ে আসার জন্যে এমন পরিবেশ খুব দরকার। জানি সন্তানদের মঙ্গলের জন্যেই আমরা অনেক কঠোর হই। এই কঠোরতা সব সময় থাকা বা করাটা ঠিক নয়।
অভ্র আর অর্পিতা এতটাই বেস্ট হয়েছে অন্যদের সাথে খুব একটা মিলেমিশে চলতে পারে না। মিশতে পারেও না। কোনদিন একজন স্কুলে না গেলে অন্যজনকে তা জানিয়ে দেয়। অন্যজন যে কোন অজুহাত করে স্কুল কামাই দেয়। এটা বুঝতে পারি গতবছর। অর্পিতা অন্য স্কুলে যাবে বলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, এতে অভ্রর মন খারাপ তবে তা প্রকাশ করে না। যেই অর্পিতা অন্য স্কুলে চান্স পায়নি, অমনি সে খুশি। গতবছর কয়েকদিন স্কুল কামাই দিয়েছে দুজনেই। বছরের প্রথম অভ্রকে বলে দিই,
– আমাদের রুটিন এ স্কুল কামাই বলতে কিন্তু কিচ্ছু নেই।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে, রাত সাড়ে দশটা হবে। অভ্র কথা বলল অর্পিতার সাথে। মুখ ভারি করে বসে আছে। বুঝতে পেরে কিছু না জিজ্ঞেস করে অপেক্ষা করছি। অভ্র এসে বলে,
– একটা কথা বলি রাগ করো না।
– বলো।
– আসলে অর্পিতা স্কুলে না এলে আমারো যেতে ইচ্ছে করে না।
কথাটা শুনে প্রথমে একটু কড়া ভাষায় কথা বলি। পরে ওকে বুঝাই,
– এটা ঠিক নয়, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকবে, তাই বলে অন্যদের সাথে তুমি চলবে না, মিশবে না, অন্যদের সাথে টিফিন খাবে না এটা তো হবে না। সবার সাথেই চলতে শিখতে হবে, তাহলে সামনের দিকে নিজেকে সহজ করে তুলতে পারবে সবার সাথে। আজ দুজন একসাথে আছো, কাল তো নাও থাকতে পারো। তখন তুমি সমস্যায় পড়ে যাবে। এই কালকের জন্যেই তোমায় আজ প্রস্তুতি নিতে হবে।
অভ্র বিষয়টা বুঝে, জানি মেনে নিতে কষ্ট হবে। আমিও জানি এই কষ্টই ওকে পরের জন্যে গড়ে তুলবে। অর্পিতার আম্মুকে ও জানিয়ে দিই। কে কবে স্কুলে আসবে না, তা অন্যকে বলা যাবে না। এইভাবে সন্তানদের পাশে আমাদের থাকতে হবে। ওদের কথা বলতে দিতে হবে। তাহলে ওরা নিজেকে যেমন তৈরি করতে পারবে তেমনি ভালো মন্দের বিষয় বুঝতে পারবে।