জনপ্রিয় অনেক গানের রচয়িতা আফতাব মাহমুদ খুরশীদ। যেমন- মাইলস্-এর ‘ফিরিয়ে দাও’ ‘জ্বালা জ্বালা’ ‘এক ঝড় এসে ভেঙ্গে দিয়ে গেল’ ‘ধ্বিকি ধ্বিকি আগুন জ্বলে’ ‘বয়ে চলে’ ‘হৃদয়হীনা’ ‘নিলা’ ‘কি যাদু’ অকট্যাব এর ‘তুমি চলে গেছ’, ফিডব্যাক এর ‘জয় হোক’ ওয়ারফেস-এর ‘ধুপছায়া’ ‘আশা’ ইত্যাদি। এগুলো ব্যন্ডের ক্ষেত্রে, সলোর ক্ষেত্রে যেমন- মেহেরীনের ‘দেখা হবে কি হবে না’ ‘অবাক শহর ঢাকা’ রমা’র ‘স্বপ্নযাত্রা’ কানিজ সুবর্নার ‘ময়ুরী মন’ আঁখি আলমগীরের ‘তুমি শুধু তুমি’ খালিদ হাসান মিলু’র ‘সুখ সুখ লাগে’ একটি থিম সং বাংলাদেশের বাঘের জন্য, বাঘ বাঁচাও থিমে ‘বাঘ আমাদের গর্ব, বাঘ সুরক্ষা করবো’। এটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেখা।
সদা হাস্যজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ, যার সাথে কথা বললে সময় হারিয়ে যায়, তিনি হলেন শিশু সাহিত্যিক ও অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা জনাব আফতাব মাহমুদ খুরশিদ। তিনি কর্পোরেট বাংলাদেশে একজন অন্যতম Brand Catalyst and Business Marketing specialist (ব্র্যান্ড অনুঘটক এবং ব্যবসা বিপণন বিশেষজ্ঞ)। বর্তমানে তিনি সিএমও, হিসেবে বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে, কর্মরত আছেন। সিটি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যংক, সিমেন্স, এসিআই, ট্রাস্ট ব্যংকসহ বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মাধ্যমে তিনি বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে (Marketing and Brand Communication) বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করে থাকেন এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে Business Talk Show তে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
তাঁর সম্পর্কে বললে আরো অনেক বলার আছে। তাঁর সাথে আমাদের (কচিপাতা’র) যে স্মরণীয় আড্ডা হয়েছে তার কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরলাম :

কচিপাতা : আপনার শৈশব, কৈশোর, লেখাপড়া সম্পর্কে যদি কিছু বলেন!
আফতাব : শৈশব কৈশোর জন্ম সবকিছুই ঢাকায়। মগবাজার প্রিপারেটরি স্কুলে থ্রি পর্যন্ত পড়ে চলে আসি সেন্ট প্যার্টিক্স গ্রামার স্কুলে, সেখান থেকেই এসএসসি, এইচএসসি নটরডেম কলেজ, ফিন্যান্সে অনার্স আর ব্যাংকিং-এ মাস্টার্স, দুটোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মার্কেটিং-এ এমবিএ করেছি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ডে।
কচিপাতা : আপনার বাবা মা সম্পর্কে কিছু বলেন!
আফতাব : বাবা মরহুম খুরশিদ হোসেন ইকোনোমিস্ট ছিলেন। মা মরহুমা মমতাজ বেগম ছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল, ফিলোসফি পড়াতেন। দুজনেই আজ না ফেরার দেশে।
কচিপাতা : ওনাদের সাথে আপনার আদর, শাসনের সম্পর্কটা কেমন ছিলো?
আফতাব : আমরা একটু শাসনের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি। ওনারা আমাদের গাইড করতেন, আমরাও বাচ্চা ছেলের মতো তা মেনে চলতাম।
কচিপাতা : কবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন?
আফতাব : কবিতা না ছড়া লিখি, সেভেন থেকে। স্কুলে দেয়াল পত্রিকা আমরাই করেছিলাম। এভাবেই লেখা শুরু তারপরে সাহস করে একবার শিশু একাডেমির ‘শিশু’ পত্রিকায় লেখা পাঠাই, বোধ হয় জোবেদা খানমের হাতেই আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।
কচিপাতা : কিসের উপর লেখা ছিল ?
আফতাব : ছড়া। আমার মনে হয় সবাই ছড়া দিয়েই শুরু করে, নাকি? একসময় ‘নবারুণ’-এ আমার লেখা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতো। নবারুণের সম্পাদক ছিলেন কবি খালিদা এদিব চৌধুরী, সুমনা হকের মা। পরবর্তীতে ওই লেখাগুলো দুটো বই আকারে বের হয়েছিলো। একটি ‘বিজ্ঞানের অবাক বিস্ময় রোবট’ রোবোটিক্সের উপর বাংলায় প্রথম লিখা, অপরটি ‘টাকা কড়ির কথা’। এই লেখাগুলোর জন্য মূলত কবি ও সম্পাদক খালিদা এদিব চৌধুরীই অনুপ্রেরণা দানকারী। তিনি বললেন, ‘তোমার প্রবন্ধ লেখার হাত ভালো, তুমি লিখো’।
কচিপাতা : আপনি বলেছিলেন বাবা মায়ের ভয়ে আপনি কবিতা লিখতেন না, এখন আপনি বাবা হিসেবে কি বলবেন?
আফতাব : আসলে তখন বিষয়টাই ছিলো এমন যে কবিতা-টবিতা লিখলে বাবা-মা’রা ভাবতেন, ‘লেখা-পড়া বুঝি আর হলো না, সব গোল্লায় গেলো, ছেলে বাউন্ডেলে হয়ে গেল, তাই হয়তো তারা লেখালেখির বিষয়টা সাপোর্ট করতেন না। আমি এমন কিছু বলি না, আমি বলি, ‘যার যেটা ইচ্ছা হয় সে সেটা করুক’ যেমন আমার মেয়ে এলিনর, প্লেতে পড়ে, রোযায় মূল স্কুল বন্ধ। তবু সে আর্ট স্কুলে গিয়ে আর্ট শিখছে। সেদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তুমি গান গাইতে পছন্দ কর নাকি নাচতে পছন্দ কর? আর কি কি কর?’ কালকে সে আরো বাইশটা লিস্ট দিলো, সে এগুলো করে।
কচিপাতা : সে ভবিষ্যতে কি হতে চায়?
আফতাব : কিছু না। আমরা জানি, সে এখন কিছুই হতে পারবে না। সে যা খুশি তাই করুক। আমার কাজ তাকে একটি সুন্দর পরিবেশ দেয়া, সে তার মনমতো যা করতে পারে তাই করবে। এখনতো আর খেলাধুলার মাঠ নাই। তারা স্কুল করে বিল্ডিং এর মধ্যে। এজন্য তাদের বিকশিত হওয়া সুযোগও কম। তাই তারা যদি সৃজনশীল কাজের মধ্যে থাকে তবে তারা বিভিন্নভাবে বিকশিত হতে পারে, তাদের মন-মানসিকতা বড় হয়, তারা অনেক শিখতে পারে, জানতে পারে। শুধু লেখা পড়া দিয়ে কিছু হয় না। ভালো রেজাল্ট দিয়ে যে সবকিছু হবে এমনটি নয়। খুব ভালো রেজাল্টও দেখেছি আমরা, কিচ্ছু পারে না, মুখস্থ করে পাস করেছে। জ্ঞানটা দরকার, ঠিক রেজাল্টা না। পড়াশোনা অবশ্যই করতে হবে। পড়াশোনার উদ্দেশ্য
হবে শুধু রেজাল্ট নয় জ্ঞান অর্জন
করা।

- কন্যারি সাথে আফতাব মাহমুদ খুরশীদ
কচিপাতা : এখন যেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, যেমন আমার সন্তান ফার্স্ট হবে, ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, অর্থাৎ নিজেদের ইচ্ছা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া…
আফতাব : আমি এটা চাপিয়ে দিতে চাই না, আমরাও খুব একটা চাপিত ছিলাম না। আমাদের সময় বাবা-মা’রা চাইতো যে, সরকারী চাকরি হলো খুব ভালো, প্রেস্টিজিয়াস। কিন্তু এখন চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছে। আমরা এভাবেই দেখি। ঐ সময়ের সিএসপি আর এখনকার বিসিএস অফিসার এক না। তবে সবাই অদক্ষ তেমন নয়, দক্ষ লোকের পরিমাণ খুবই কম। এজন্য দায়ি- এডুকেশন সিস্টেম, আমাদের পারিপার্শ্বিকতা বা আমাদের সামাজিক সিস্টেম।
কচিপাতা : এই চলমান এডুকেশন সিস্টেম ও সামাজিক সিস্টেম থেকে মুক্তির উপায় কি?
আফতাব : মুক্তির উপায়- নিজে জ্ঞান অর্জন করলে, নিজে সচেতন থাকলে ‘নিজে ভালো তো জগৎ ভালো’। কারণ বাইরের লোককে তো আপনি মানুষ করতে পারবেন না। আগে নিজেকে মানুষ হতে হবে। নিজে মানুষ হোন এভাবে সবাই মানুষ হয়ে যাবে।
কচিপাতা : তবে আমরা শিক্ষা বলতে- তথাগত শিক্ষা বা একাডেমিক শিক্ষাকে বুঝি, আসলে প্রকৃত শিক্ষা হলো তার বাইরের শিক্ষা…
আফতাব : একাডেমিক শিক্ষা হলো বেইজ বা ফাউন্ডেশন। একটি ভবন তুলতে গেলে ফাউন্ডেশন লাগে। তার উপরে আপনি কত তলা তুলবেন, নকশাটা কেমন হবে সেটা আপনার ইচ্ছা। ফাউন্ডেশন যদি ভালো হয় তবে সবকিছুই ভালো হবে।
কচিপাতা : অভিভাবকরা অনেক সময় নিজেরা যেটা হতে পারেন নি সেটা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন…
আফতাব : যে যেটা পায় নি, সে সেটা সন্তানের মধ্যে দেখতে চায়। এটা সম্ভবত অনেকেই চায়, এটা চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। নিজের স্বপ্নগুলো সন্তানের মধ্যে দেখতে চায়। তবে আমি তা চাই না, আমি চাই আমার সন্তান নিজের মতো করে বড় হোক।
কচিপাতা : আমরা এখন আপনার গান লেখা বিষয়ে জানতে চাই, আপনি গান লিখতে শুরু করলেন কিভাবে?
আফতাব : ইউনিভর্সিটিতে পড়ার সময় সবাই জানতো আমি একটু লেখালেখি করি, তখন ইউনিভার্সিটির এক বড়ভাই বলল, আমরা তো ব্যান্ড করি, কিছু গান লিখে দাও, ক্যাসেট করবো। যেহেতু ছড়া-কবিতা লেখার অভ্যাস আছে তাই গানও লিখে ফেললাম, ছন্দ জানা থাকলে সবকিছুই লেখা যায়। গানই কবিতা আবার কবিতাই গান। গান হিসেবে লেখা আমার প্রথম গান ‘এক ঝড় এসে ভেঙ্গে দিয়ে গেলো’
কচিপাতা : আপনার লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর কথা যদি বলেন…
আফতাব : জনপ্রিয় গানতো অনেক রয়েছে। যেমন- মাইলস্-এর ‘ফিরিয়ে দাও’ ‘জ্বালা জ্বালা’ ‘এক ঝড় এসে ভেঙ্গে দিয়ে গেল’ ‘ধ্বিকি ধ্বিকি আগুন জ্বলে’ ‘বয়ে চলে’ ‘হৃদয়হীনা’ ‘নিলা’ ‘কি যাদু’ অকট্যাব এর ‘তুমি চলে গেছ’, ফিডব্যাক এর ‘জয় হোক’ ওয়ারফেস-এর ‘ধুপছায়া’ ‘আশা’ ইত্যাদি। এগুলো ব্যন্ডের ক্ষেত্রে, সলোর ক্ষেত্রে যেমন- মেহেরীনের ‘দেখা হবে কি হবে না’ ‘অবাক শহর ঢাকা’ রমা’র ‘স্বপ্নযাত্রা’ কানিজ সুবর্নার ‘ময়ুরী মন’ আঁখি আলমগীরের ‘তুমি শুধু তুমি’ খালিদ হাসান মিলু’র ‘সুখ সুখ লাগে’ এ বছর লিখলাম ফিডব্যাকের জন্য, মাইলস্ এর জন্যও লিখছি, একটি থিম সং লিখলাম বাংলাদেশের বাঘের জন্য, বাঘ বাঁচাও থিমে ‘বাঘ আমাদের গর্ব, বাঘ সুরক্ষা করবো’। এটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লিখেছি।
কচিপাতা : কচিপাতা’র শ্লোগান হচ্ছে ‘সব শিশুকে নিয়ে যাবো এগিয়ে’। তাই কচিপাতা ও শিশুকিশোরদের নিয়ে আপনার ভাবনা ও কিছু করার ইচ্ছা আছে কি?
আফতাব : আমি এ যাবতকাল যতো বই লিখেছি সব শিশুদের জন্যে, অবশ্য বড়রাও পড়তে পারবে। আমিই প্রথমে ‘রোবোটিক্স’ এর উপর একটি বাংলা বই লিখতে শুরু করলাম।
কচিপাতা : আপনার পেশা সম্পর্কে কিছু বলুন
আফতাব : আমি আমার পেশাকে ভীষণ উপভোগ করি। কেননা আমার পেশা ও সৃজনশীলতা দুটো অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ব্রান্ড সৃষ্টি করতে হয়। ব্রান্ডিং এমন একটি জিনিস যেখানে গান, মিডিয়া, লেখালেখিসহ সকল সৃজনশীলতা কাজে লাগে। যেমন রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন একজন মহান সৃজনশীল মানুষ তেমনি আবার এই সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেই একটি ব্রান্ড।
গল্প এগিয়েই চলতে থাকে বহতা নদীর মতো। এই গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। আবার লিখলেও এই পত্রিকার সকল পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু আফতাব মাহমুদই থাকবে। তা হলেও মন্দ হতো না। কিন্তু কিছু প্রচলিত নিময় মেনে চলতে গিয়েই গল্প সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করতে হয়। তাঁর সাথে পথ চলা সত্যি অত্যন্ত সুখের বিষয়। তাঁর এগিয়ে চলা, তাঁর কাজ, তাঁর ভাবনা, তাঁর বহমান সফলতা আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। তাকে আমরা আরো নতুন নতুনভাবে জানতে চাই, চিনতে চাই। তাঁর মুখের হাসি ও কিছু করার সদিচ্ছা সদা অটুট থাকুক।
পারিবারিক জীবন : স্ত্রী, কণ্যা, দুইভাই, দুইবোন এর সুন্দর পারিবারিক জীবন আফতাব মাহমুদ খুরশিদের।
সাক্ষাতাকার গ্রহণে : মোদাচ্ছের হোসেন