না বলা গল্পের মাঝেও গল্প থেকে যায় বলার।
এমনি একটা গল্প থেকে তৈরি হয়েছিল “আমার বন্ধু রাশেদ” সিনেমাটি। সরকারি অনুদানে বিশিষ্ট লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর জনপ্রিয় একটি শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটা নির্মাণ করেছেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম।
২০১১ সালের ১ এপ্রিল মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধে শিশুদের অবদান দিয়ে অলংকৃত এ সিনেমাটি। মমন চলচ্চিত্র ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি: এর ব্যানারে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়।
সিনেমার শুরুতে দেখা যায় এক ভদ্রলোক তার ছেলের সাথে ট্রেনে করে তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। তিনিই তার শৈশবের, গ্রামের, বন্ধুদের গল্প বলছেন তার ছেলেকে। গল্পে জানা যায় ভদ্রলোকের ডাকনাম ইবু।
গল্পের শুরুটা ১৯৭০ সালে। লাড্ডু নামের একটা ছেলে ভর্তি হয় ইবুদের স্কুলে। লাড্ডু নামটি কিছুটা অদ্ভুত ও হাস্যকর হওয়ায় ক্লাসের স্যারের সেটা পছন্দ হয় না। তিনি সব ছাত্রকে লাড্ডুর জন্য একটা সুন্দর নাম লিখে আনতে বলেন।
এভাবেই লাড্ডুর নাম হয়ে যায় রাশেদ হাসান। আর এ রাশেদকে নিয়েই শুরু হয় আমাদের আজকের গল্প “আমার বন্ধু রাশেদ”-এর।
রাশেদের কথা শুনলে কিছুটা অদ্ভুতুড়েই শোনাবে। যেন রাশেদের কম বয়সী কিশোর শরীরে কোন পৌঢ় জ্ঞানী ব্যক্তি ভর করে আছেন।
অবশ্য রাশেদের মতে ওর এমন কথাবার্তার জন্য দায়ী ওর বাবা। রাশেদের ভাষ্যমতে ওর বাবা কিছুটা পাগলা কিসিমের।
তিনি তার ছেলের সাথে বসে রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষের সাথে কিভাবে অবিচার করছে, বঙ্গবন্ধুকে তারা কোনভাবেই ক্ষমতায় যেতে দিবে না, এসবই রাশেদকে জানান।
রাশেদ ইদানীং আবার মশাল মিছিলে যায় আর সে সব কথাও তার বন্ধু ইবুকে মাঝেমাঝে জানায়। ইবুরা রাশেদের কথা যত শুনে ততই অবাক হয়।
একদিন রাশেদ ইবুদের পাড়াতে বেড়াতে যায়, আর সেখানেই রাশেদের পরিচয় হয় শফিক ভাইয়ের সাথে। ইবুর ধারণা দুনিয়াতে এমন কোন কাজ নেই যা শফিক ভাই জানে না। বিস্কুট বানানোটাও সে শিখেছে শফিক ভাইয়ের মাধ্যমে।
শফিক ভায়ের কাছেই ওরা গরীব বাচ্চাদের জন্য ওষুধ বানানো শিখতে চায়।
ইবুর মাধ্যমে রাশেদের সাথে পরিচয় হয় অরু আপারও। অরু আপা বেশ মজার মানুষ, ইবুদের ফুটবল দলের জার্সি তৈরি করে দেন আবার ইবুর সাথে বেশ হাসি ঠাট্টাও করেন।
মজায় মজায় কাটতে থাকে রাশেদ-ইবুদের দিনগুলো, অনেক কিছু শিখে ওরা শফিক ভাইয়ের কাছে থেকে।
এরপরে আসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনারা। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় সারাদেশে। দিনাজপুরে ইবুদের ছোট্ট শহরেও যুদ্ধের সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
দলে দলে পাকিস্তানীদের অত্যাচারে জীবনের ভয়ে পালাতে থাকে মানুষেরা।
পালিয়ে যায় ইবুর বন্ধু দিলীপও ওর পরিবারের সাথে ভারতের পথে, নিজ দেশের ভিটামাটি ছেড়ে। দিলীপের কান্নাভেজা মুখটা দেখে প্রচণ্ড কষ্ট পায় ইবু।
এদিকে পাকি বাহিনী দিনাজপুর আক্রমণ করে এপ্রিলের ৩০ তারিখে। এরমাঝেই গঠিত হয়েছে মুক্তিবাহিনী। শফিক ভাইও যোগ দিয়েছেন দেশকে রক্ষা করতে মুক্তিবাহিনীতে। এদিকে দেশকে রক্ষার জন্য যখন দেশের অকুতোভয় সন্তানেরা লড়ছে, তখন দেশকে অন্যের কাছে বেঁচে দেয়া রাজাকারেরা সাহায্য করছে পাকিস্তানী বাহিনীকে। এসব খবর রাশেদ এসে জানায় ইবুদের। দেশের জন্য কিছু করতে ওরা উৎসুক হয়ে ওঠে। এরমাঝে একদিন রাশেদ ভয় দেখিয়ে মজা নেয় শান্তি কমিটি অর্থাৎ রাজাকার বাহিনীর লোক আজরফ আলীর সাথে।
এদিকে দিনকে দিন দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। কঠিন সময় পার করতে থাকে দিনাজপুরবাসীও। বাড়ি থেকে প্রায় বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায় ইবুদের। একদিন ইবু শুনে ওদের স্কুলে পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাম্প করেছে। সেদিন রাশেদ বলে স্কুলের ম্যাপ থাকলে মুক্তিবাহিনীর সুবিধা হবে ক্যাম্পে হামলা করতে। সৌভাগ্যবশত স্কুলের ম্যাপ ছিল আশরাফের কাছে। রাশেদরা সেই ম্যাপ নিয়ে দেয়ার কথা ভাবে মুক্তিবাহিনীকে। একদিন ইবু অরু আপাদের বাসায় থাকার কথা বলে রাশেদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সাথে দেখা করতে যায়। সেখানে ইবু দেখে মুক্তিযোদ্ধা শফিক ভাই আর ওদের বন্ধু কাদেরকে। কাদেরও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
এদিকে রাশেদদের থেকে স্কুল তথা পাকিস্তানী ক্যাম্পের নকশা নিয়ে হামলার পরিকল্পনা করে মুক্তিবাহিনী।
আর ইবু, রাশেদ আর ওদের বন্ধুরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে গুলি পৌঁছে দেয়। ওরা দেশের নামেও শপথ করে। পাকিস্তানী ক্যাম্প আক্রমণের দিন যুদ্ধে অংশ নেয় ইবু আর রাশেদ।
শফিক ভাইয়ের ঘাড়ে এক সময়ে গুলি লাগে আর উনি ধরা পড়ে যান পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে। কোনভাবে পালিয়ে আসে ইবু আর রাশেদ। এদিকে এলাকায় রটে যায় পাকিস্তানী ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর হামলার কথা। ইবু কান্না করতে থাকে শফিক ভাইয়ের কথা ভেবে। মিলিটারিরা শফিক ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করে।
রাশেদ, ইবু, ফজলু আর আশরাফ সিদ্ধান্ত নেয় শফিক ভাইকে মুক্ত করার।
ইবুরা যখন জিজ্ঞাসা করে তখন রাশেদই বলে পুরো পরিকল্পনাটা ওদের সাথে। ওরা দেশের নামে শপথও করে যদি ওদের কেউ ধরাও পড়ে তাহলে যেন কোনভাবেও অন্যদের নাম না বলে। একটা চৌকস পরিকল্পনা আর অদম্য সাহসের বলে রাশেদরা মুক্ত করতে সমর্থ হয় শফিক ভাইকে। এদিকে দেশের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে উঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে ইবুর বাবা শহর ছেড়ে চলে যান পরিবারের সবাইকে নিয়ে। আশরাফ আর ফজলুরাও চলে যায় শহর ছেড়ে। শুধু থেকে যায় রাশেদরা। যাবার দিন খুব কষ্ট পায় ওরা। রাশেদের থেকে ইবু অবশ্য জানে ওদের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর স্থায়ী ফ্রন্ট খোলার কথা। কিন্তু ইবু থাকতে পারে না রাশেদের সাথে।
নৌকায় যেতে যেতে ইবু ওদের অপারেশনের কথা বলে অরু আপাকে। অরু আপা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান ইবুর কথা শুনে। ৯ মাস যুদ্ধের পরে স্বাধীন হয় প্রাণের বাংলা, জন্ম হয় বাংলাদেশের। ইবুরা শহরে ফিরে আসে জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখে। যুদ্ধে ভাঙা সব কিছুই যেন অচেনা লাগে ইবুর কাছে। ফজলু আর আশরাফের সাথে দেখা করে ইবু। ওদের থেকে শুনে একটা ভয়ানক কথা। রাশেদ মারা গিয়েছে। রাজাকার বাহিনীর আজরফ আলী রাশেদকে গুলি করে মেরে ফেলে নদীর পাড়ে। রাশেদের শেষ আকুতি ওর বাধা চোখ খুলে দিয়ে দেশকে শেষবারের জন্য দেখার ইচ্ছাটা আর পূরণ হয় না। বুকে এসে লেগে ওর প্রাণটা বের করে দেয় রাজাকারের বন্দুকের গুলিটা।
মুক্তিযুদ্ধে কিশোরদের অবদানের অনেকটা স্বীকৃতিস্বরূপ রচনা “আমার বন্ধু রাশেদ”!
যুদ্ধের দিনে সেদিনের কিশোররা কিভাবে দেশের জন্য নিজেদের জীবনকে বাজী রেখে কাজ করেছে তাই দেখানো হয়েছে এ সিনেমায়।
আমাদের এ প্রজন্মের সবার-ই সেদিনের কিশোরদের এ বীরত্বগাথা জানা উচিত। এবং আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া উচিত ওদের আত্মত্যাগের গল্পটা। তাই আমাদের অভিভাবকদের উচিত দেশের ইতিহাস ও ইতিহাসের বীর সন্তানদেরকে তাদের সন্তানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য হলেও একসাথে দেখে ফেলা উচিত “আমার বন্ধু রাশেদ” সিনেমাটি।
সবশেষে কিছু ধন্যবাদ সিনেমার কলাকুশলী ও অভিনেতা তথা রাইসুল ইসলাম আসাদ, হোমায়রা হিমু, পারভেজ মুরাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইনামুল হক, কেরামত মওলা ও ওয়াহিদা মল্লিক জলি প্রমুখদের তাদের সুন্দর, স্বচ্ছ অভিনয়ের জন্য; যা থেকে এই সুন্দর গল্পটা প্রাণ পেয়েছে পর্দায়।
আর হ্যাঁ ওই চার কিশোরদেরকে অর্থাৎ জাওয়াতা আফনান, ইবতেশাম চৌধুরী, রিফায়েত জিন্নাত, ফাইয়াজ বিন জিয়া কে তো ধন্যবাদ দিতেই হয়, যাদের ঘিরে পুরো সিনেমাটি গড়ে উঠেছে।
তাহলে আর অপেক্ষা কেন, সামনের কোন ছুটির দিনে পরিবারের সবার সাথে বসে পড়ি সুন্দর এই সিনেমাটি দেখতে।
আমাদের আগামী প্রজন্ম তথা এখনকার শিশুরাও জানুক আমাদের বীরদের গল্প।
পরিচালক : মোরশেদুল ইসলাম
প্রযোজক : ফরিদুর রেজা সাগর
উৎস : মুহম্মদ জাফর ইকবাল কর্তৃক
আমার বন্ধু রাশেদ
অভিনেতা :
কাওসার আবেদিন
চৌধুরী জাওয়াতা আফনান
রাইসুল ইসলাম আসাদ
পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়
ওয়াহিদা মল্লিক জলি
রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী
ইনামুল হক
আরমান পারভেজ মুরাদ
হুমায়রা হিমু
কাজী রায়হান রাব্বি
লিখন রাহি
ফাইয়াজ বিন জিয়া
রাফায়েত জিন্নাত
সুরকার : ইমন সাহা
চিত্রগ্রাহক : এল অপু রোজারিও
সম্পাদক : রতন পাল
পরিবেশক : মমন চলচ্চিত্র, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
মুক্তিকাল : ১ এপ্রিল ২০১১ (বাংলাদেশ)
দৈর্ঘ্য : ১০০ মিনিট
দেশ : বাংলাদেশ
ভাষা : বাংলা
নির্মাণব্যয় : ৩০,০০০,০০
আয় : ৬০,০০০,০০
লেখা : তাহমিদ শুভ