সিনেমা পর্যালোচনা
সিনেমা : দূরত্ব
পরিচালক: মোরশেদুল ইসলাম
গল্প : হুমায়ুন আহমেদ
মুক্তিকাল : ২০০৪
আমাদের সমাজের দুইটা
ভিন্ন রূপ আছে, ঠিক যেমন একই মুদ্রার দুইটা আলাদা পিঠ।
মুদ্রার দুইটা পিঠ যেমন খুব কাছে থেকেও একে অপরের থেকে খুব ভিন্ন, ঠিক তেমনি আমাদের সমাজের এ রূপ দুটিও খুব ভিন্ন একে অপরের থেকে।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের আরো একটি জাতীয় পুরস্কার জয়ী শিশুতোষ ঘরনার সিনেমা ‘দূরত্ব’!
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদপুরুষ হুমায়ুন আহমেদের লেখা গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এ সিনেমাটি।
গল্পটা যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তার নাম পুতুল।
পুতুল সম্ভ্রান্ত ও ধনী ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান ও জেসমিন রহমানের একমাত্র ছেলে। গুলশান এলাকায় আছে তাদের বিশাল প্রাসাদতুল্য বাড়ি।
এই বাড়িতে সব কিছুই আছে পুতুলের জন্য। শুধু যেটার অভাব পুতুল অনুভব করে প্রচ-ভাবে সেটা ওর বাবা-মায়ের সঙ্গ!
কাজের ব্যস্ততায় ওর বাবা-মা ওকে কোন সময়-ই দিতে পারে না। অগত্যা পুতুলের সময় কাটে টিভি দেখে, গেমস খেলে আর গল্পের বই পড়ে। পুতুলের জন্য একটা আয়াও রাখা আছে, সে-ই মূলত পুতুলের খাওয়া-দাওয়া আর সব কিছুর খেয়াল রাখে।
কিন্তু পুতুল এসব কিছুর মাঝেও অভাব অনুভব করে।
অভাব অনুভব করে ওর বাবার আদরের, মায়ের শাসন-আদরের।
সেই যে সকালে বের হয়ে যায় কাজের জন্য বাবা-মা, তারপরে ফিরে সেই রাতে। ততক্ষণে ঘুমিয়ে যায় পুতুল।
ঘুমানোর আগে পুতুল চায় তার মা তাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াক, কিন্তু পুতুলের সে ইচ্ছা পূরণ হয় না।
পুতুলের জন্য নিয়মিত খুব ভাল ভাল খাবার রান্না করা হয়, কিন্তু পুতুলকে একা একা-ই খেতে হয়।
পুতুলের সেটা একদমই ভাল লাগে না, সে চায় তার বাবা-মা তার সাথে বসে একসাথে খাবার খাক। একা একা খাবার খাওয়ার অনিচ্ছা-ই ওকে সুস্বাদু খাবারেও টানে না। এভাবেই চলছিল পুতুলের চার দেয়ালের মাঝের জীবন।
হঠাৎ একদিন পুতুল দেখে ওদের বাসার গেটটা খোলা, দারোয়ান চাচাও আশেপাশে নেই। সুযোগ বুঝে পুতুল বেরিয়ে পড়ে বাইরে। দেখার জন্য ওর থেকে লুকানো প্রতিটা ভিন্নজগত।
যেতে যেতে রাস্তায় ওকে আদর করে গুড়ওয়ালা চাচা ওকে পাটালি গুড় উপহার দেয়। সেই সাধারণ গুড় খায় পুতুল পরম তৃপ্তিতে।
একটা সময়ে পুতুল গিয়ে বসে একটা পার্কে। পার্কে ওর সাথে পরিচয় হয় এক পথশিশুর সাথে, যার নাম অন্তু মিয়া। অন্তু মিয়ার একটা কুকুর ছানাও আছে। অন্তুর থেকে পুতুল জানতে পারে অন্তু থাকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে, ওখানেই রাতে ঘুমায় সে।
মাঝেমাঝে ভিক্ষাও করে। অন্তুর বাবা থাকে ময়মনসিংহ স্টেশনে।
অন্তুর সাথে পুতুলের সখ্যতা হয়ে যায়। ওরা দুজনে মজা করতে
বেরিয়ে পড়ে।
অন্তু আর পুতুল দুজনে পুকুরে মাছ ধরতে নামে, দুইটা মাছও পায় তারা। তবে নিজের গেঞ্জিটা হারিয়ে ফেলে পুতুল পুকুরে। গেঞ্জি উদ্ধার করতে গিয়ে প্রায় ডুবে যাওয়া থেকে একমহিলা বাঁচায় পুতুলকে।
এদিকে পুতুলের বাসায় হইচই পড়ে গেছে পুতুলকে না পেয়ে। পুতুলের বাবা পুলিশের সহায়তা নিয়ে পুতুলকে খুঁজতে থাকেন। মাইকিং করা শুরু হয় আশেপাশের এলাকায় পুতুলের বর্ণনা দিয়ে।
নিমতলী থেকে একজন পীর সাহেবকেও নিয়ে আসা হয়, শোনা যায় উনি নাকি কাপড় শুকে নিখোঁজ মানুষের খোঁজ বলে দিতে পারেন।
ওদিকে অন্তু আর পুতুল ঘুরতে থাকে ঢাকার নানা জায়গা। অন্তু পুতুলকে জানায় ওর একটা বোন আছে, মরিয়ম নাম। থাকে কমলাপুর রেলস্টেশনে।
অন্তুর সাথে পুতুল চলে কমলাপুর অন্তুর বোনে েেদখতে। মরিয়ম মেয়েটাকে পুতুলের অদ্ভুত লাগে, মেয়েটা কথায় কথায় হাসে।
এদিকে পুতুলের বাবা আর ধৈর্য ধরতে না পেরে পুতুলের নিখোঁজ সংবাদ পত্রিকাতে দিয়ে দেয়।
এটাও ঘোষণা দেয়, যে তার পুতুলের খোঁজ দিতে পারবে তাকে সে ২লক্ষ টাকা পুরস্কার দিবেন।
পুরস্কারের লোভে নানা জায়গা থেকে মিথ্যা ফোন আসতে থাকে।
কেউ কেউ বলে তারা পুতুলকে অপহরণ করেছে, মুক্তিপণ হিসাবে তাদের ২০লক্ষ টাকা দিতে হবে। পুতুলের বাবা রাজিও হয়ে যায় কালক্ষেপণ না করে।
এদিকে সকাল হয়ে যায়, অন্তু আর মরিয়মের সাথে পুতুল হাঁটতে হাঁটতে পুতুলদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়।
মরিয়ম পুতুলদের বাসা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, পুতুলরা রাজা কিনা! কারণ মরিয়মের ধারণা এত বিশাল বাড়িতে শুধু রাজারাই থাকতে পারে।
পুতুল জিজ্ঞাসা করে ওদের, ওর সাথে ওর বাসায় আসবে কিনা।
ওরা না করে নিজেদের অবস্থা ভেবে।
পুতুল বুঝতে পেরে চলে যায় নিজের বাসায়, যাবার আগে দিয়ে যায় সারারাত ধরে ওর গায়ে জড়িয়ে ওকে গরম রাখা মরিয়মের ছেঁড়া সোয়েটারটা।
পুতুলকে দেখে পুতুলের বাবা-মা আনন্দে ফেটে পড়েন যেন। পুতুলকে আদর করতে থাকেন অফুরন্ত।
আর অন্তু আর মরিয়ম তখন রাস্তার ধারে কাগজ পুড়িয়ে আগুনে নিজেদের শরীর সেকে গরম করছে। আসলে গরীবদেরও শীত করে।
একটাই পৃথিবীতে বাস করা দুইটা ভিন্ন জগতের গল্প এত সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাব গল্পকার হুমায়ুন আহমেদকে।
পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের অনন্য পরিচালনা সিনেমাটিকে দিয়েছে এক অন্যমাত্রার প্রাণ।
সিনেমার সকাল কলাকুশলীদের পাশাপাশি বিশেষ করে ধন্যবাদ না জানালেই নয় প্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, সুবর্ণ মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আজাদ, হাকিম ফেরদৌস, ওয়াহিদা মল্লিক জলিকে তাদের অনন্য অভিনয়ের জন্য।
আর ভুলে যাবার মত নয় ফাহাদ আর অমল যারা যথারীতি পুতুল আর অন্তু চরিত্র চরিত্রায়ন করছে।
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেডের প্রযোজনা ও পরিবেশনায় নির্মিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী এ সিনেমাটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় আমাদের সমাজেই আমরা কত বড় দূরত্ব তৈরি করে রেখেছি মানুষের সাথে মানুষের মাঝে।
অবসরে এ সিনেমাটি দেখার পাশাপাশি অনুরোধ করব নিজের সাধ্যের মাঝে আমাদের সমাজের নিচের মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। এ একটা কাজেই আমাদের সমাজের মানুষের সাথে মানুষের মাঝের দূরত্ব কমবে আর ধনী-গরীব না, আমরা মানুষ হিসাবে বাঁচতে শিখব।
লেখা: তাহমিদ শুভ