১৯৬৯ সাল। টালমাটাল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলা, মহকুমা তথা জনপদ। ইতিহাসের পাতায় গণ অভ্যুত্থানের বছর। আমি তখন সদাসদী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। একদিন হেড স্যার অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর সকল ছাত্রছাত্রীকে জড় হতে বললেন হলরুমে। ৮ম শ্রেণীর ‘এ’ ও ‘বি’ সেকশনের মাঝের অস্থায়ী পার্টিশন খুলে বানানো হলরুম।
আমরা ছুটে গেলাম। আতঙ্কিত সবাই। হেড স্যার রাশভারী লোক। এবার হেড স্যারের নির্দেশ। ভয়ে জরসর সবাই। কি জানি কি হয়। এমনিতেই পারতপক্ষে আমরা টিচার্স কমন রুমের সামনেও যেতাম না। ক্লাসের মনিটরের দায়িত্ব ছিল আমার উপর। শিক্ষকদের নির্দেশে লিকলিকে বেত আনার জন্য মাঝে মধ্যে কমন রুমে যেতে হতো। হলরুমে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের বামদিকের সারিতে বসতে বলা হলো। সামনে চৌকি। চৌকির উপর তিনটি হাতাওয়ালা কাঠের চেয়ার।
মাঝখানের চেয়ারে সাদা ধূতি ও ফুলশার্ট পড়া হেড মাস্টার স্যার। বাবু যতীন্দ্র চন্দ্র সাহা। ডানে বামে আরো দুইটি চেয়ারে দুই জন বসা। হলভর্তি গুঞ্জন। থামতে বললেন হেড স্যার। পিনপতন নিরবতা। তিনি শুরু করলেন। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, গোপালদী বাজার শাখার ম্যানেজার এবং ক্যাশিয়ার এসেছেন। তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শুরু হল মূল আলোচনা। আজকের শিশু আগামী দিনে দেশের দায়িত্ব নেবে। তোমাদের মধ্যে কেউ হবে ব্যাংকার, কেউ রাষ্ট্রনায়ক, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, চাকুরিজীবী আরো কত কি। তবে দেশের উন্নয়নের জন্য দরকার সঞ্চয়। সঞ্চয়ের কাজটি আজকের হলরুমে যারা রয়েছো তারা অনায়াসে করতে পার। তোমরা অনেকেই মাটির ব্যাংকে, বাঁশের চোঙায় টাকা রাখো।
এ অভ্যাস ত্যাগ করে ব্যাংকে হিসাব খুলে টাকা রাখার সুযোগ নিতে পারো। স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় হিসাব খোলা যাবে। ব্যাংকের লোকজন সপ্তাহে দুইদিন স্কুলে আসবে। তাদের নিকট টাকা জমা দেয়া যাবে আবার উঠানোও যাবে। সর্বনিম্ন জমা হবে ২৫ পয়সা। ১ টাকা দিয়ে হিসাব খোলা যাবে। ১ টাকা ২ টাকা করে সঞ্চয় করলে একসময় দেখা যাবে লাখ টাকা হয়ে গেছে। এ টাকা দিয়ে অনেক কিছুর ব্যয় মিটাতে পারবে।
ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেবের বেশভূষা ভদ্রোচিত। কাল পেন্ট, ধবধবে সাদা ফুল হাতা শার্ট, কাল বেল্ট। মুখে হাসি। ক্যাশিয়ার সাহেবও ফিটফাট। ভাল লেগে গেল। তাৎক্ষণিক হিসাব খোলা শুরু। বন্ধু রতনের কাছ থেকে ১/- টাকা চেয়ে নিলাম। হিসাব খোলা হল আমার নামে। স্টুডেন্ট সেভিংস একাউন্ট। নম্বর এসবিএস-১৭৩। সাথে মিনি সাইজের একটি পাশ বই। ১/- টাকা জমার ঘরে পোস্টিং দিয়ে লাল কালিতে ক্যাশিয়ার সাহেব সই করে নিশ্চিত করলেন। এভাবে একজন একজন করে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্র/ছাত্রীরা বহু হিসাব খুললেন। হিসাবের বিপরীতে পাশ বই পেয়ে সবাই খুশি।
এরপর কেটে গেছে বহু বছর। দেশ স্বাধীন হয়েছে। জাতি উদযাপন করেছে স্বাধীনতার ঊনচলিশ বছর। এ সময় ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে স্কুল শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাংকিং একাউন্ট খোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। স্কুল ব্যাংকিং সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একটি দৈনিককে বলেন, একটি কর্মক্ষম জাতি গঠনে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি এখন থেকেই শিশুদের জন্য ব্যাংকিং জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা তথা আধুনিক শিক্ষার বীজ বপন করা দরকার। এ লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে স্কুল ব্যাংকিং সেবা চালু করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দেশ সেবার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ আবশ্যক। এ কর্মকাণ্ডে অবদান রাখার নিমিত্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা হলে দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বৃদ্ধি পাবে। আধুনিক ব্যাংকিং সেবা ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। ডিজিটাল যুগের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারবে। স্কুল ব্যাংকিং স্কীমের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে ব্যাংকিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মোচন করে দেয়া জরুরী। এতে অদূর ভবিষ্যতে এরাই হবে আস্থাশীল গ্রাহক কিংবা প্রতিশ্র“তিশীল ব্যাংকার। তাই শিশুদের কোমল হৃদয়ে সঞ্চয়ের বীজ বপন করা আবশ্যক এবং তা এখনই।
স্কুল ব্যাংকিং এর আওতায় হিসাব খোলা ও পরিচালনা খুবই সহজ। ছয় থেকে আঠার বছরের কম বয়সী আগ্রহী ছাত্রছাত্রীরা তাদের মা-বাবা অথবা বৈধ অভিভাবকের সঙ্গে যৌথ নামে হিসাব খুলতে পারে। মাত্র ১০০ টাকা প্রাথমিক জমা দিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক শাখায় এই হিসাব খোলা যায়। এ হিসাবে কোন চার্জ আরোপ করা হয় না। এমনকি ন্যূনতম স্থিতি রাখার বাধ্যবাধকতাও নেই। এ কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে বেতন-ফি জমা দিতে পারবে। বৃত্তি বা উপ-বৃত্তির অর্থ স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় শিক্ষার্থীদের হিসাবে জমা করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদানকারী সরকার, আধা সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত কিংবা বেসরকারী সংস্থাগুলোকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে সমঝোতা চুক্তি করতে হবে।
আশার কথা দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড পরিচালনা পর্ষদ ৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পরিষদের ১৮৯তম সভায় ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ব্যাংকিং স্কীম (ঝইঝ) নামে একটি স্কীম চালুর নীতিমালা অনুমোদন করেছেন। এ স্কীমের আওতায় ছাত্র/ছাত্রীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে এককভাবে হিসাব পরিচালনা করতে পারবে। এ স্কীমের আওতায় হিসাব খোলার পর ছাত্র/ছাত্রীদেরকে উৎসাহ প্রদানের নিমিত্ত সোনালী ব্যাংক একটি বলপেন এবং ব্যাংকের মনোগ্রাম সম্বলিত নোটবই সরবরাহের ব্যবস্থা করছে যা খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালের জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্কুল ব্যাংকিংয়ে হিসাব সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ৭১৯টি। এর আগের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা ৬৭ হাজার ২২০টি ছিল।
জুন, ২০১৪ সময়ে স্কুল ব্যাংকিং হিসাবের বিপরীতে রাখা আমানতের পরিমাণও বেড়েছে। চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত এসব হিসাবে জমিয়ে রাখা আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ৩ মাসের ব্যবধানে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৭০,৪৫২টি এবং আমানত বেড়েছে ৬২ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে স্কুল শিক্ষার্থীদের স্কুলে ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯ হাজার ৮০টি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে বর্তমানে দেশে কার্যকর মোট ৫৩টি ব্যাংকের মধ্যে ৪৭টি ব্যাংকই স্কুল ব্যাংকিং চালু করেছে।
তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে চালু করা স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এগিয়ে আছে। ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলো ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২৫৪টি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩১ শে মার্চ ২০১৪ ভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৬৮,৩৩৪টি, বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলো ৫১,৪৫৮টি, বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২ লাখ ৪৫,৭০৬টি, বিদেশি ব্যাংকগুলো ৬৭২টি এবং নতুন ব্যাংকগুলো ৮৪টি স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাব খুলেছ্।ে ২০১৩ সাল শেষে তফসিলি ব্যাংকগুলোর স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাব সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯৫,৮০২টি। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৩ শেষে স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাবগুলোতে আমানতের পরিমান ছিল ৩০৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শক্রমে এ খাতে হিসাব খোলার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যা খুবই আশাব্যঞ্জক।
মোঃ মোফাজ্জল হোসেন