বসেছিলাম সমুদ্র সৈকতে পাশে। শেষ বিকেলের নরম আলোয় ভালোই লাগছিল। ছোট ছোট ঢেউয়ের তীর ছুঁয়ে আবার সাগরে ফিরে যাওয়া, নোঙর করা জাহাজগুলোর জলরাশির উপর ভেসে থাকা, দর্শনার্থীদের কারো কারো নৌকা ভ্রমণ বেশ উপভোগ করছিলাম। সাগরের দিকে মুখ করে বসেছিলাম বলে পেছন দিকটায় তেমন খেয়াল নেই। সূর্য তখন ডুবি ডুবি করছে। সেই শেষ আলো যখন সাগরের পানিতে পড়লো তখন যে অপরূপ সৌন্দর্য তৈরি হল তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমি হৃদয়ের সবটুকু মুগ্ধতা নিয়ে দেখছিলাম সেই অপরূপা সাগরের বর্ণনাতীত রূপ। ঠিক এই সময় মৃদু কণ্ঠের একটি ডাকে পেছনে তাকালাম। বয়স নয় কী দশ হবে মেয়েটির। তেলের অভাবে বাদামী চুলগুলো রুক্ষ, চোখ দু’টিতে এত মায়া কে দিল কে জানে! সবুজ রংটি ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না জামাটি মলিন হয়ে যাওয়ার কারণে।
আফা! দশটা টাকা দেন না!
আগেও হয়তো একথাই বলেছিল আমি খেয়াল করিনি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক ভিক্ষুকের মত নয়, কিছুটা অনুনয় মিশে আছে তার চাওয়ায়। একটু কৌতূহল হল। এবার তার দিকে ভালোভাবেই ফিরে বসলাম।
কি করবি দশ টাকা দিয়ে? সবাই এক টাকা, দু’টাকা চায় তুই একেবারে দশ টাকা! হেসে জিজ্ঞেস করলাম।
স্যারকে দিতে হবে। তিনশ টাকা নিয়ে স্যার নোট দেবেন।
কথায় কিছুটা অঞ্চলিক টান থাকলেও যথসম্ভব শুদ্ধভাষায় তার সহজ সরল উত্তর আমার ভেতরটা একটু নাড়িয়ে দিল। পেশাদার ভিক্ষুকরা বিভিন্ন বাহানা দেখায় তাই একেবারে অন্যরকম উত্তরে একটু আশ্চর্যই হলাম! স্বাভাবিকভাবে কৌতূহল আরো বাড়লো। আরো বিস্তারিত জানার ইচ্ছে হল। তাই ইচ্ছে করেই অন্যদের উদাহরণ দিয়ে বললাম, সত্যি বলছিস? নাকি অন্যদের মত নতুন একটা বাহানা খুঁজে বের করছিস?
মার কাছে শুনবেন? মাকে ডাকি?
যেন চ্যালেঞ্জ করলো আমাকে, কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। বললাম, একটু বসবি! তোর সাথে কিছু কথা বলি?
বসলে তো সময় চলে যাবে। রাত বেশি হলে মা বকবে।
বেশি সময় বসতে হবে না। কিছু কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে। তাই বসতে বললাম।
সে বসলো না। আবার চলেও গেলো না। হয়তো আমার মত ওরও কৌতূহল অথবা অনেক আশা। অথবা হয়তো এভাবে কেউ কথা বলে না।
নাম জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল, সায়মা আক্তার। মা শামু ডাকে।
স্যারের কথা বলছিলি, স্কুলে পড়িস?
হাত দিয়ে অদূরে ইশারা করে বললো, ও-ই যে ওখানে, একটি প্রাইমারি স্কুল আছে, ওখানেই পড়ি। চতুর্থ শ্রেণিতে।
খুব আগ্রহের সাথে বললো। অনেকটা সহজ এখন সে আমার সাথে। কাঁধ পর্যন্ত পড়ে থাকা রুক্ষ, বাদামি চুলগুলো উড়ছিল বাতাসে।
বাসায় কে কে আছে শামু?
আমি। আমার ছোট তিনভাই বোন, মা আর বাবা।
বাবা কি করে?
কিছু করতে পারে না। তিনবছর আগে একবার এক্সিডেন্ট হইছিল। সেই থিক্যা বিছানায়। হাঁটতে পারে না। বিছানায় শুয়ে থাকে সারাদিন। আর মায়েরে বকে!
বিষাদের কালো ছায়া খেলে যায় শ্যামলা মুখটিতে।
কেন বকে?
জানি না। আপনি কি আমারে টাকা দিবেন? বেশ খানিকটা বিরক্তির সাথে বললো।
কিন্তু সরকার তো এখন বই খাতা সব ফ্রি দিচ্ছেন। এখন তো পড়ালেখা করার জন্য তোমার কোন টাকা লাগার কথা নয়। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য বললাম।
না, স্যার বলেছে স্যারের কাছ থেকে নোট না নিলে পরীক্ষায় পাস করতে পারব না।
নিজেও শিক্ষক। তাই হয়তো খারাপ লাগলো এই ভেবে যে, সেই স্যার তো নিশ্চয় জানেন এই সব শামুদের কথা। তবু কিভাবে নোটের কথা বলে টাকা চায় এদের কাছ থেকে? প্রশ্নটা নিজের মধ্যেই রেখে জানতে চাইলাম।
শামু, তোর রোল নম্বর কত?
এবার খুশিতে একগাল হেসে উত্তর দিল, দুই। স্যার মাকে বলেছেন আমি ভালোছাত্রী। পড়াশোনা ভালোভাবে করলে একদিন অনেক বড় হব। তাইতো মা পাঠাইছেন স্যারের জন্য টাকা জোগাড় করতে।
বিবেক দ্বিতীয়বারের মত মর্মাহত হল। একজন মেধাবী ছাত্রী কি তার স্যারের কাছ থেকে বিনা টাকায় নোট পাওয়ার সাহায্যটুকু পেতে পারে না! খুব ইচ্ছে করছিল প্রশ্নটি সেই স্যারকে করি সরাসরি।
স্যারতো বলেছেন তুই পড়ালেখা করলে অনেক বড় হতে পারবি। বলতো বড় হয়ে কি হবি? প্রশ্নটি ওকে করলেও রাগ হচ্ছিল তার স্যারের উপর।
শিক্ষক। হাসির ঝিলিকের সাথে উজ্জ্বল চোখ জোড়াও।
কেন? স্যারের মত নোট দিয়ে অনেক টাকা আয় করতে পারবে তাই? হেসে জিজ্ঞেস করলাম।
না, আমার ছোট ভাই-বোনদের পড়াব। মা তো তখন অনেক বুড়ো হয়ে যাবে। মানুষের বাসায় আর কাজ করতে পারবে না। গায় শক্তি থাকবে না। তাই।
আমি স্তব্ধ, নির্বাক, এই শিক্ষা কোন পাঠশালায় দিতে হয় না। মেয়েটি তার জীবন থেকেই পেয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। যা ওই স্যার দিতে পারেননি। কিন্তু ওর প্রকৃতি থেকে যে শিক্ষা, তা আমাকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে। ওর সামনে নিজেকে খুব ছোট মনে হল। ভাগ্য এদের সাথে প্রবঞ্চনা করলেও মনুষ্যত্বের শিক্ষা ঠিকই পেয়েছে। হঠাৎ ওর মাকে দেখার প্রচুর ইচ্ছে জাগলো মনে। আমার চিন্তার ফাঁকেই সে বিষণœ সুরে বললো, আফা যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রাত হলে মা বকবে।
বাস্তবে ফিরে এলাম। ব্যাগ খুলে দু’শ টাকা ওর হাতে দিয়ে বললাম, রাখো শামু এটা।
ইচ্ছে হচ্ছিল তিনশ টাকার সবটাই ওকে দিই। কিন্তু ফিরতে হবে তাই গাড়ি ভাড়ার টাকাটা রাখলাম। এই পাওয়াটা হয়তো অনেক বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল তার জন্য। খুব অবাক হয়ে বললো, এত টাকা?
রাখো আমি তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম। তোমাকে আরো একশ টাকা যোগাড় করতে হবে।
সম্বোধন নিজের অজান্তেই কখন ‘তুমি’তে চলে এসেছিল জানি না।
আফা! আপনি খুব ভালো। আমি যাই?
আর অপেক্ষা করলো না। আমি পেছন থেকে ওর চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। আমি জানি না আসলেই এই মেয়েটি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে কিনা। কত মেধাবী শামু এভাবে পড়ালেখা করে বড় হওয়ার বাসনা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক’জনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে? কত শামুকে সংসারের হাল ধরার জন্য মাঝপথে পড়ালেখা থামিয়ে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে রোজগারের সন্ধানে। মন থেকে দোয়া করলাম এই মেয়েটির স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। ও যেন সত্যিই একদিন শিক্ষক হতে পারে। হয়তো ওরাই পারবে সত্যিকারের জাতি গঠন করতে। এত কম বয়সেই ওদের চিন্তা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়িয়ে কত ঊর্ধ্বে! আর আমরা? সে যে আমাকে ভালো বললো আমি কি আসলেই ভালো? ভালো হলে কেন তাকে পুরো টাকাটা দিয়ে দিলাম না! পারিনি তো তাকে পুরো টাকাটা দিতে! পারিনি বলেই, স্বার্থ চিনি বলেই ব্যাগে যে টাকা গাড়ি ভাড়া হিসেব করে রেখে দিয়েছিলাম তা পারিনি দিতে। বাসায়ই যখন ফিরবো গাড়ি ভাড়া ম্যানেজ ঠিকই করতে পারতাম। অথবা মেয়েটির হয়ে দু’একজনকে আমি নিজেই অনুরোধ করতে পারতাম। স্বার্থ আর অবস্থান থেকে নড়তে পারিনি বলেই পারিনি। শামুর এসবের বালাই নেই। ও অবিচল ওর সিদ্ধান্তে! তাই আর একশ টাকা যোগাড় করার জন্য যাচ্ছে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে। ওর তেলহীন, রুক্ষ বাদামী চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। আস্তে আস্তে সে সরে যাচ্ছে আমার দৃষ্টি সীমানার অন্তরালে…।